বলরাম দাশ অনুপম, কক্সবাজার

  ১৯ মে, ২০২২

কক্সবাজারে পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ে কর্মচারী সিন্ডিকেট

৫১ একর আবাসন প্রকল্পকে ৫৬ একরে রূপ দিতে প্রশাসনের ৪র্থ শ্রেণির দুই কর্মচারীর নেতৃত্বে আরো ৫ একর পাহাড় ও বনাঞ্চাল উজাড় করে বসতি নির্মাণের কাজ চলছে। এরই মধ্যে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে দুইবার উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হলেও দমাতে পারেনি এই দখলবাজ সিন্ডিকেটকে। রোহিঙ্গা শ্রমিক দিয়ে রাত-দিন পাহাড় ও বনাঞ্চল উজাড় করে সমতল ভূমি তৈরি এবং বসতি নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে। যাদের নেতৃত্বে নতুন করে এই দখল কার্যক্রম চলছে তারা হলো ৫১ একর আবাসন প্রকল্পের সভাপতি ও চকরিয়া কাকরা ভূমি অফিসের এমএলএসএস সুলতান মোহম্মদ বাবুল ও সিভিল সার্জন অফিসের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী মোহাম্মদ ইয়াছিন। মূলত এই দুজনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠেছে দখলবাজি সিন্ডিকেট।

এদিকে কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ কক্সবাজার কলাতলীর ৫১ আবাসন প্রকল্প পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ৫১ একরের সঙ্গে লাগোয়া জয়নাল সওদাগরের ঘোনা নামের আরো ৫ একর পাহাড় নিধনের দৃশ্য দেখেন।

পাশাপাশি ঘটনাস্থলে তিনি সরকারি পাহাড় দখল করে পাহাড় ও গাছ কাটার সত্যতা পাওয়ায় সেখানে লাল কালিতে সরকারি জমি লিখে সাইনবোর্ড স্থাপন, বাঁধ অপসারণ ও বনায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে পাহাড় ও বনাঞ্চল নিধন করে স্থাপনা বানানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিল্লুর রহমানকে নির্দেশ প্রদান করেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আমিন আল পারভেজ বলেন, পাহাড় ও বনাঞ্চল উজাড় করে বসতি নির্মাণের সঙ্গে সরকারি কয়েকজন ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী জড়িত থাকার সত্যতা প্রাথমিকভাবে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যারা জেলা প্রশাসনের রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে দখলবাজ সিন্ডিকেট নিয়ে কয়েকজন অফিসার কাজ করছে।

পাশাপাশি পাহাড় ও বনাঞ্চল নিধন করে যে বসতি ওঠেছিল তা উচ্ছেদ করা হয়েছে। যদি পনিরায় আবারও বসতি ওঠে থাকে তাহলে তাও উচ্ছেদ করা হবে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কক্সবাজার জেলা কালেক্টরেট কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের ব্যানারে গড়ে ওঠা ৫১ একর আবাস প্রকল্পকে ৫৬ একর প্রকল্পে রুপ দিতে কলাতলীতে আরো পাঁচ একরের বেশি সরকারি পাহাড় কেটে সাবার করা হয়েছে।

সরকারি পাহাড় রোহিঙ্গা শ্রমিক দিয়ে নির্বিচারে কেটে ফেলার অভিযোগ উঠলে কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে দুই দফা অভিযান চালানো হয়। অভিযানে কয়েকটি অবৈধ ঘর উচ্ছেদ ও বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়। কিন্তু এরপরও অদৃশ্য কারণে পাহাড় কাটা থামানো যাচ্ছে না।

এসবের নেতৃত্ব দিচ্ছে ৫১ একর আবাসন প্রকল্পের সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ বাবুল ও সিভিল সার্জন অফিসের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী মোহাম্মদ ইয়াছিন। তাদের সঙ্গে রয়েছে সরকারি কর্মচারী জুলফিকার আলি ভুট্টো, মাছন ফকির, ইয়াকুব মাঝি ও জয়নাল সওদাগরসহ ১০ জনের সিন্ডিকেট।

পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, এক মাস ধরে ১৫/২০ জন রোহিঙ্গা শ্রমিক দিয়ে দিনে-রাতে প্রকাশ্যে সরকারি ৫ একরের একটি বিশাল পাহাড় কেটে ফেলা হচ্ছে। পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশিত হলে জেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের নজরে আসে। ফলে কয়েকবার করে পরিদর্শন করেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরিদর্শনকালে জড়িত সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলাসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ রাষ্ট্রের আইন মানা ও তা বাস্তবায়ন করা। কিন্তু কক্সবাজারে তার উল্টো। হাইকোর্ট ২০১১ সালের ৮ জুন জেলা কালেক্টরেট কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের ৫১ একর আবাসন প্রকল্প বরাদ্দ বাতিল, পাহাড়ের কোনো অংশ না কাটা, রক্ষিত বন এলাকায় সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা ও বন ধ্বংস না করার আদেশ দেন। যা এখনো বহাল রয়েছে। তারপরও উচ্চ আদালতের রায় তোয়াক্কা না করে প্রতিনিয়ত পাহাড় ও বনাঞ্চল ধ্বংস করে বসতবাড়ি নির্মাণ করছে প্রশাসনের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরা।

এদিকে যাদের নেতৃত্বে পাহাড় নিধন করে বসতি নির্মাণের অভিযোগ ওঠেছে তাদের মধ্যে জেলা প্রশাসনের কর্মচারী সুলতান মোহাম্মদ বাবুল ও সিভিল সার্জন অফিসের কর্মচারী মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, ৫১ একর প্রকল্পকে ৫৬ একর প্রকল্পে রূপ দেওয়ার জন্য সব পরিকল্পনার মূল হচ্ছে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী পরিষদের সভাপতি জেলা প্রশাসনের নাজির স্বপন কান্তি পাল। আমরা তার অর্ডার বাস্তবায়ন করছি।

৫১ একরে যারা প্লট পাইনি তাদের অনেককেই প্লট দেওয়ার জন্য ৫ একর পাহাড় সমান করে বসতি নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানান সিভিল সার্জন অফিসের কর্মচারী ইয়াছিন। স্বপন কান্তি পাল বলেন, বর্তমানে পাহাড় ও বনাঞ্চল নিধন করে বসতি নির্মাণের সঙ্গে আমি কোনোভাবেই জড়িত নাই। যারা আমাকে জড়াচ্ছে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। পাশাপাশি নিজেদের অপকর্ম ডাকানোর জন্য আমার নামটি জড়িয়ে দিচ্ছে। কক্সবাজার সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিল্লুর রহমান বলেন, পাহাড় কাটার বিষয়ে এরই মধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তা দ্রুত পালন করা হবে। পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক শেখ মো. নাজমুল হুদা বলেন, পাহাড় কাটার ওই স্থানে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে দুই দফা পরিদর্শন করে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close