কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম

  ২০ জানুয়ারি, ২০২২

বিদেশি জাহাজ মালিকদের কাছে জিম্মি সমুদ্র বাণিজ্য

বছরে দেশ থেকে যাচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকা

বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন বিদেশি জাহাজ মালিকরা। দেশের জাহাজ মালিকদের সুরক্ষার আইন কাগজে-কলমে থাকলেও মানা হচ্ছে না। অন্যদিকে বাড়ছে না দেশীয় জাহাজের কলেবর। বিদেশিদের নানা কৌশলের কাছে হার মেনে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর জাহাজ ভাড়া বাবদ বিদেশিরা নিয়ে যাচ্ছেন প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, তারা তথ্য গোপন করে দিচ্ছে আয়কর। ঠিক কী পরিমাণ টাকা তারা এ দেশে আয় করছেন এবং কী পরিমাণ টাকা বিদেশে জাহাজ ভাড়া হিসেবে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এটা চলছে যুগ যুগ ধরে। এর সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষীদের।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন সূত্র জানায়, দেশে আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে সমুদ্রগামী জাহাজ খরচ প্রায় চার বিলিয়ন ডলার। যার প্রায় ৯৫ শতাংশ বিদেশি জাহাজ মালিকরা নিয়ে যাচ্ছেন। বিএসসির বহরে ৪০-৫০টি জাহাজ থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও অর্থাভাবে গত ২৭ বছরে কোনো জাহাজ সংযোজিত হয়নি।

চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, বাংলাদেশি জাহাজ তেমন নেই বলে তারা একচেটিয়া রাজত্ব করছেন। আগে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) অনেকগুলো জাহাজ ছিল। তার সঙ্গে দেশীয় মালিকানাধীন বেশ কটি জাহাজও সক্রিয় ছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে প্রতিযোগিতায় বিদেশিদের সঙ্গে তারা পাল্লা দিয়ে চলতে পারেননি। বিএসসিকে শক্তিশালী করলে এ খাত আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানান, একই ট্রেডে দুটি সংগঠন হতে পারে না। অথচ আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশে তা হচ্ছে। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমেই যেখানে সবার কাজ করা উচিত, সেখানে বিদেশিরা একটি সংগঠন দাঁড় করে দিয়েছেন।’ সাবেক বিএনপি জোট সরকারের আমলে তাদের সংগঠনের অনুমতি দেওয়া হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে মামলার পর মামলা হলেও তারা বহাল তবিয়তে চলছেন।

বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমি দেশের স্বার্থে মামলা-মোকদ্দমা করে বিদেশি জাহাজ মালিকদের আটকাতে অনেক চেষ্টা করেছি। তারা বাংলাদেশে কোনোপ্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই ব্যবসা করে যাচ্ছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, তাদের কেউ কেউ এখন বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য টার্মিনালের আবদার করছেন।’

আহসানুল হক আরো বলেন, দেশ থেকে জাহাজ ভাড়া বাবদ যে বিশাল অঙ্কের টাকা চলে যাচ্ছে তা ঠেকাতে হলে দেশীয় জাহাজশিল্পের উন্নয়ন প্রয়োজন। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে শক্তিশালী করা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশের সমুদ্রগামী জাহাজশিল্পকে রক্ষার জন্য ১৯৮২ সালে প্রণীত হয় ফ্ল্যাগ ভেসেল প্রটেকশন অর্ডিন্যান্স। এ অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে, আমদানি ও রপ্তানি মালামাল বহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ অগ্রাধিকার পাবে। মূলত দেশের স্বার্থে বিদেশি জাহাজ কোম্পানির মনোপলি বা একচেটিয়াত্ব ভেঙে দেশি জাহাজশিল্প গড়ে তোলার জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আইনে বলা আছে, বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি রুটের মাল পরিবহনের জন্য বন্দরে উপস্থিত না থাকলে শুধু সে পরিস্থিতিতে বিদেশি জাহাজ ডিজি শিপিংয়ের কাছ থেকে ওয়েভার বা অনাপত্তিপত্র নিয়ে মাল তুলতে পারবে। এ ধরনের আইন শুধু বাংলাদেশে নয়, উন্নত ও উন্নয়নশীল বহু দেশেই রয়েছে। জাতিসংঘের আংকটাড রুলসে বলা হয়েছে, সমুদ্রগামী পণ্য পরিবহন ব্যবসা ৪০-৪০-২০ নীতিতে ভাগাভাগি হবে। অর্থাৎ ৪০ শতাংশ পাবে রপ্তানিকারক দেশ, ৪০ শতাংশ পাবে আমদানিকারক দেশ, অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নেবে মুক্তবাজার প্রতিযোগিতায়, যার সামর্থ্য বেশি সে। এর ভিত্তিতেই আংকটাডে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ‘ফ্ল্যাগ প্রটেকশন অর্ডিন্যান্স’ জারি করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশি জাহাজ অন্তত ৪০ শতাংশ পণ্য পরিবহন করবে। সামর্থ্য অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে এটা বেড়ে যাবে। এ আইনটি এখন কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। যদিও বর্তমান সরকারের আমলে ৪০ শতাংশকে বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু খুব একটা ফল পাচ্ছে না দেশীয় মালিকরা। একটাই কারণ দেশের জাহাজ বলতে গেলে তেমন নেই। এ সেক্টরকে সুকৌশলে পঙ্গু করে ফেলা হচ্ছে। তা না হলে বিপুল পরিমাণ টাকা দেশেই থাকত।

অভিযোগ উঠেছে, বিদেশিদের সঙ্গে যোগসাজশে দেশবিরোধী স্বার্থান্বেষী চক্র কৌশলে ধ্বংস করে ফেলেছে দেশের সমুদ্রগামী জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে (বিএসসি)। একসময় এ প্রতিষ্ঠানের ৪৪টি জাহাজ ছিল। বিএসসিকে পঙ্গু করার পর বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণে আসতে থাকে বাংলাদেশের শিপিং সেক্টর। দেশের স্বার্থে করা পতাকা আইনটির প্রয়োগ অকার্যকর হয়ে যায়। এরই মধ্যে গড়ে উঠে দেশের বেসরকারি জাহাজশিল্প। গঠিত হয় বাংলাদেশ ওসেন গোয়িং শিপিং অ্যাসোসিয়েশন (বোগসোয়া)। বেসরকারিভাবে বাংলাদেশি জাহাজের সংখ্যা বাড়তে থাকলে বিদেশি চক্রটি এ দেশীয় চক্রের হোতাদের নিয়ে ফ্ল্যাগ প্রটেকশন আইনটি বাতিলের ষড়যন্ত্র শুরু করে। বিদেশিরা গত ২০০৩ সালে এ অধ্যাদেশ সংশোধন করাতে সক্ষম হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বিদেশিদের আর অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই বলে সংসদে সংশোধনী পাস হয়। এটি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত দেশীয় জাহাজ সেক্টর আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।

জানা গেছে, বাংলাদেশের সমুদ্র বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বিদেশি জাহাজ মালিকদের একটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। বাংলাদেশে তারা ‘ইন্টারন্যাশনাল কনটেইনার অ্যাসোসিয়েশন (ইকসা) নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। দেশে ‘বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’ নামে একটি সংগঠন থাকার পর ট্রেড অর্গানাইজেশন নীতিমালায় অন্য কোনো সংগঠন হতে পারে না। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় তারা নিজেদের একটি সংগঠন করে শিপিং বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়।

গত বিএনপি সরকারের আমলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বিদেশিদের সংগঠনটি তৎপরতা শুরু করে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশের শিপিং ব্যবসা শতভাগ বিদেশিদের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। পরে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে দেখা করে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিষয়টির ব্যাপারে তার সহযোগিতা চান। একপর্যায়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বরাবর ইউরোপিয়ান কমিশন, ফ্রান্স, কোরিয়ান, আমেরিকান, সুইডেন ও ডেনমার্কের অ্যাম্বাসেডররা লিখিত চিঠি দেন। তাতে তারা বাংলাদেশে বিদেশিদের ব্যবসার সহজভাবে পরিচালনার জন্য লাইসেন্স প্রদানের বিষয়টি উল্লেখ করেন। মূলত এরপর থেকে দেশে একচেটিয়া ব্যবসা করে যাচ্ছে বিদেশি শিপিং লাইনগুলো।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি বছর বাড়ছে কনটেইনারবাহী আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ। প্রতি বছর গড়ে পরিমাণ বাড়ে প্রায় ২০ শতাংশ। এ সুযোগে বেড়েছে কনটেইনারবাহী জাহাজের পরিমাণও। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৪০-৫০টি কনটেইনার জাহাজ বর্তমানে আমদানি-রপ্তানি পণ্য বহনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সিঙ্গাপুর-কলম্বো-মালয়েশিয়ার তিনটি রুটে কনটেইনার জাহাজে তাদের পণ্য আনা-নেওয়া করে। আগে দেশীয় জাহাজের মধ্যে বাংলাদেশি পতাকাবাহী বেসরকারি এইচআরসি শিপিংয়ের মালিকানাধীন আটটি এবং সরকারি বিএসসির দুটি জাহাজ থাকলেও বিদেশিদের কাছে তারা টিকতে পারেনি।

জানা গেছে, বর্তমানে সমুদ্রপথে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ বছরে প্রায় তিন লাখ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এই পণ্যসামগ্রী পরিবহনের জন্য ১৫ শতাংশ জাহাজ ভাড়া বাবদ খরচ হয়। যার পরিমাণ প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে পুরো টাকাটাই জাহাজ ভাড়া হিসেবে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে গেলেও তারা তথ্য গোপন করে আয়কর প্রদান করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি ও বিরোধী দলের কিছু প্রভাবশালীর যোগসাজশ রয়েছে। সরকারের পর সরকার বদল হলেও এ ব্যাপারে কোনো সফলতা আসেনি। ক্রমেই মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে সরকারের মালিকানাধীন শিপিং সেক্টরটি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close