জোনাহিদ হাসান সাগর, কালীগঞ্জ (গাজীপুর)

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২২

বড় মাছে জামাই খুশি

বিনিরাইলে মাছের মেলা

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার বিনিরাইল এলাকার আড়াই শ বছরের পুরোনো মাছের মেলাটি এ অঞ্চলের মানুষের কাছে শীতকালীন সবচেয়ে বড় উৎসব হিসেবে সমাদৃত। জানা গেছে, আশপাশের গ্রামের মেয়ের জামাইরা এ মেলা থেকে সবচেয়ে বড় মাছ কিনে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যান। এতে জামাই ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন খুশিতে হন আত্মহারা। শ্বশুরও কম যান না, তিনি মেলার বড় মাছটি কিনে মেয়ের জামাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এবার এ মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশের উপজেলায়ও বিরাজ করে উৎসবের আমেজ।

ঐতিহ্যবাহী এই মেলা প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। মূূলত এটা জামাই মেলা হলেও সবাই একে মাছের মেলাই বলে। কারণ স্থানীয় জামাই এবং শ্বশুরদের মধ্যে চলে বড় মাছ কেনার প্রতিযোগিতা। প্রতি বছর সারা দেশ থেকে বিক্রেতারা এখানে মাছ নিয়ে আসেন। তাই দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারাও ছুটে আসেন মাছ কিনতে।

গতকাল শুক্রবার বিকালে এই মেলায় গিয়ে দেখা গেছে ৪০ কেজি ওজনের একটা বাগাড় মাছকে ঘিরে ক্রেতা জামাইদের জটলা লেগে আছে। বিক্রেতা দাম হেঁকেছেন ৬৫ হাজার টাকা। ক্রেতাদের মধ্যে স্থানীয় কাপাইশ গ্রামের জামাই মো. হোসেন আলী মাছটির দাম সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা বলছেন। কিন্তু বিক্রেতা আরো বেশি দাম পাওয়ার আশায় মাছটি ছাড়ছেন না। চলছে দর-কষাকষি। যত না ক্রেতা তার চেয়ে অনেক বেশি উৎসুক জনতা ভিড় জমিয়েছেন মাছটি দেখার জন্য।

বিরাট এলাকাজুড়ে মাছের পসরা সাজিয়ে বসেন মাছ বিক্রেতারা। সহস্রাধিক স্টলে দেশের বিভিন্ন জায়গার মাছ বিক্রেতারা এখানে মাছ বিক্রির জন্য ছুটে আসেন। তারা নানা অঙ্গভঙ্গি করে সুর ধরে ডেকে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। কেউ কেউ বড় আকৃতির মাছ ওপরে তুলে ধরে ক্রেতাদের ডাকছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়, কে কত বেশি ওজনের বা বড় মাছ মেলায় আনতে পারেন। অন্যদিকে স্থানীয় জামাই-শ্বশুরদের মধ্যেও হয় সেই বড় মাছ কেনার নীরব প্রতিযোগিতা।

আয়োজকদের সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন তো এসেছেনই। এর বাইরে বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে অনেকে এসেছেন উপজেলার সর্ববৃহৎ এই মাছের মেলায়। গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ থেকে অনেক মানুষ শুধু এই মেলা উপলক্ষেই কালীগঞ্জে এসেছেন। প্রতি বছর অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয় এ মেলা। তখন আয়োজন করা হয় নবান্ন উৎসবেরও। এবারের মেলায় পাঁচ শতাধিক মাছ ব্যবসায়ী বাহারি মাছ নিয়ে আসেন। মেলায় মাছ ছাড়াও মাছের সঙ্গে এই মেলায় আসবাবপত্র, খেলনা, মিষ্টি, বস্ত্র, হস্ত ও কুটিরশিল্পের নানা পণ্যেরও আমদানি হয়। মাছের মেলায় সামুদ্রিক চিতল, বাগাড়, আইড়, বোয়াল, কালি বাউশ, পাবদা, গোলসা, গলদা চিংড়ি, বাইম, কাইকলা, রূপচাঁদা মাছের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা রকমের দেশি মাছও।

মাছ নিয়ে মেলায় আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ষাটোর্ধ্ব এক মাছ ব্যবসায়ী জানান, তিনি ৪০ বছর ধরে এই মেলায় দোকান করেন। শুরুতে বেচাকেনা ভালো হলেও বর্তমানে তেমন হয় না। কারণ কোন্দলের জন্য বিনিরাইলের মেলাটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। বিনিরাইলের পাশেই চুপাইর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বসে তিন দিনব্যাপী মাছের মেলা। তবে ইতিহাস ঐতিহ্যের কারণে বিনিরাইলে কেনার চেয়ে দেখতে আসা মানুষের ভিড় এখন বেশি। তা ছাড়া স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপন হওয়ায় প্রতি বছর এ মেলায় যোগ দেন তিনি। এখানে বেচাকেনাকে মুখ্য মনে করেন না বলেও জানান তিনি। মেলায় দোকান করতে পেরে তিনি আনন্দ পান।

মেলায় কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ী নয়ন কুমার দাস জানান, মেলায় প্রচুর দেশি রুই, কাতল, বোয়াল, আইড়, বাগাড়, চিতল, কালি বাউশ ও রিটা মাছের সমাগম হয়েছে। এ ছাড়া কার্পজাতীয় নানা মাছের আমদানি হয়েছে। এক কেজি থেকে শুরু করে বিশ কেজি পর্যন্ত এসব মাছের দাম হাঁকা হচ্ছে ৪০০ থেকে শুরু করে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। সামর্থ্য অনুযায়ী ক্রেতারা এসব মাছ কিনছেন। তবে বড় মাছ কেনার জন্য বিনিরাইলের মাছের মেলাই সবচেয়ে উত্তম জায়গা। তবে এবার গত বছরের চেয়ে ক্রেতাণ্ডবিক্রেতা কম।

মেলায় মাছ কিনতে আসা বিনিরাইলের মাছের মেলাসংলগ্ন জামালপুর ইউনিয়নের কাপাইস গ্রামের জামাই মো. হোসেন আলী বলেন, শ্বশুরবাড়িতে মাছ নিয়ে যাওয়ার কথা। তাই এলাকার সব জামাইয়ের নজর বিনিরাইলের মাছের মেলার বড় মাছটার দিকেই। স্থানীয় বড় মাছ ব্যবসায়ীরা সপ্তাহখানেক ধরে বড় বড় মাছ সংগ্রহ করে থাকেন। সেই অনুযায়ী মাছের দামও হাঁকা হয়। শুরুতে এ মেলা শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য হলেও, বর্তমানে এটা সব ধর্মের মানুষের কাছে ঐতিহ্যর উৎসবে পরিণত হয়েছে।

বিনিরাইলের মাছের মেলা নিয়ে কথা হয় কাপাসিয়া উপজেলার চানপুর গ্রামের মো. ফরহাদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, এবার সাড়ে ১৭ হাজার টাকার চিতল, বোয়াল, আইড়সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনেছেন বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

জামালপুর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম নুরু জানান, এই মেলাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হতো খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে। এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। প্রায় ২৫০ বছর ধরে মেলাটি আয়োজন হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।

বিনিরাইলের মাছের মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি ও ইউপি সদস্য কিশোর আকন্দ জানান, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু হওয়া বিনিরাইলের মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। এ মেলা কালীগঞ্জের সবচেয়ে বড় মাছের মেলা হিসেবে স্বীকৃত।

তিনি আরো জানান, শুরুতে মেলাটি অনুষ্ঠিত হতো ক্ষুদ্র পরিসরে। এটি অগ্রহায়ণের ধান কাটা শেষে পৌষ-সংক্রান্তি ও নবান্ন উৎসবে আয়োজন করা হতো। এটি একসময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মেলা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মেলাটি একটি সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে আয়োজন করে আসা মেলার বয়স আড়াই শ বছর ছাড়িয়েছে। তাই বেড়েছে মেলার পরিধিও। এখানে শুধু মাছ নয়, এ মেলাকে কেন্দ্র করে বস্ত্র, হস্ত, চারু-কারু, প্রসাধনী, ফার্নিচার, খেলনা, তৈজসপত্র, মিষ্টি ও কুটিরশিল্পের নানা পণ্যের সহ্রাধিক স্টল বসে। মেলাকে ঘিরে বিনিরাইলের পাশের গ্রামগুলোতে বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাইকে দাওয়াত করে আনা এই এলাকার মানুষের রীতিতে পরিণত হয়েছে।

জামালপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান ফারুক মাস্টার জানান, ব্রিটিশ শাসনামল থেকে শুরু হওয়া বিনিরাইলের মাছের মেলা এখন ঐতিহ্যে রূপ নিয়েছে। মাছের মেলাটি এ অঞ্চলের মানুষের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক। তাই মেলায় বেচাকেনা যতই হোক, এ মেলা ঐতিহ্য আর কৃষ্টি-কালচারকে বহন করছে-এমনটাই মনে করছেন স্থানীয়রা। তাই এ মেলা নিয়ে কোনোপ্রকার দাঙ্গা-হাঙ্গামা নেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close