খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

  ১৩ জানুয়ারি, ২০২২

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা

অপরিকল্পিত নগরায়ণে উদ্বেগ

বাংলাদেশে গত দশ বছরে শহরের প্রান্তে অনিয়ন্ত্রিত বসতি এবং অপরিকল্পিত ঝুঁকিপূর্ণ নগরায়ণে কৃষি ভূমি ও গাছপালা ধ্বংস হচ্ছে, ভরাট হচ্ছে জলাশয়। বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। বাড়ছে সামাজিক ও ধর্মীয় বৈষম্য। অধিকাংশ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে। বাড়ছে শ্রেণি বৈষম্য। কমছে উপার্জন সক্ষমতা। বসবাসের অযোগ্য নগর গড়ে উঠছে বলে উঠে এসেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনা (ইউআরপি) ডিসিপ্লিনের এক গবেষণায়।

গবেষণা প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউআরপি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. শিল্পি রায়। তিনি আশঙ্কা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশের শহরগুলোর সামাজিক বিভাজন ও শহরতলির পরিবর্তন উদ্বেগজনক। সেন্টার ফর সাসটেইনেবল, হেলদি অ্যান্ড লার্নিং সিটিজ অ্যান্ড নেইবারহুডসের (এসএইচএলসি) শিরোনামের একটি আন্তঃদেশীয় গবেষণা প্রকল্প বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের সাতটি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং নগরায়ণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর টেকসই সমাধান নিয়ে গত চার বছর ধরে কাজ করছে। বাংলাদেশে নগর পরিকল্পনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এটি সবচেয় বড় আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকল্প।

গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে আশঙ্কাজনক হারে নগরায়ণ হচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা শহরের আয়তন ৩০৭ বর্গকিলোমিটার (কিমি)। গত ৩০ বছরে ঢাকার আশপাশে ২৫৪ বর্গকিমি এলাকায় অপরিকল্পিত বসতি গড়ে উঠেছে। একই সময়কালে খুলনায় (মোট আয়তন ৪৬ বর্গকিমি) বেড়েছে প্রায় ১৮ বর্গকিমি এলাকা। ঢাকায় গড়ে প্রতি বছর ৮ শতাংশ হারে নগরায়ণ হচ্ছে, যে হার খুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ।

নতুন গড়ে ওঠা এসব বসতি কেড়ে নিয়েছে কৃষি জমি ও জলাভূমি। ঢাকার পাশের অঞ্চল হারিয়েছে ২৩৪ বর্গকিমি কৃষি জমি ও ৩২ বর্গকিমি গাছপালা ও জলাভূমি। অপরদিকে খুলনায় হারিয়েছে প্রায় ৪২ বর্গকিমি কৃষি জমি ও প্রায় ৫ বর্গকিমি জলাশয়। সুপেয় পানি, পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সড়ক যোগাযোগে অপ্রতুলতা রয়েছে। শহরের প্রান্তিক এলাকায় লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া। এর ফলে শহরের ভেতরের ঘনবসতিপূর্ণ প্রায় ৭০ শতাংশ মহল্লা আরো ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে।

ঢাকা এবং খুলনা উভয় শহরেই সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানরা সারা শহরজুড়ে বসবাস করছে। অথচ সনাতন ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা নির্দিষ্ট কিছু এলাকাতেই বসবাস করে। উদাহরণস্বরূপ রাজধানীর পুরান ঢাকা ও খুলনার বড় বাজার এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাসের হার মূল শহরের তুলনায় যথাক্রমে দশগুণ ও দ্বিগুণ বেশি। ধর্মের এই প্রান্তিকতা বাড়তে থাকলে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সময় ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে ঢাকা শহর অনেক বেশি বিভাজিত। নগরীর কিছু জায়গায় অভিজাতদের বসবাস। অপরাংশ নিম্ন আয়ের লোক থাকে। আয়ের ভিত্তিতে ঢাকা শহর ৮ ও খুলনা শহর ৫ শ্রেণিতে বিভাজিত। উভয় শহরেই নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে স্থানীয় বৈষম্য বাড়ছে। ঢাকার ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশ বাড়িতে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। খুলনাতে এই চিত্র আরো ভয়াবহ। ঢাকা শহরে গত ২০ বছরে সরকারি উদ্যোগে কোনো বিদ্যালয় গড়ে উঠেনি। বেশিরভাগ মধ্য ও নিম্ন আয়ের এলাকায় মানসম্মত স্কুল কম। অভিজাত আবাসিক এলাকায় ব্যয়বহুল ও মানসম্মত স্কুল আছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উভয়ই শহরে নাজুক। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ক্লিনিক, ফার্মেসি ইত্যাদি গড়ে ওঠায় যানজট সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার প্রান্তিক এলাকার মানুষদের এই সুবিধা নিতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।

গবেষকরা নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশ্যে ৪টি প্রধান সুপারিশ করেছেন। প্রথমত, ঢাকা এবং খুলনা উভয়ের জন্য শহরতলীর পরিকল্পনাটাই আগামীর মূল চ্যালেঞ্জ। এই পরিকল্পনা শহরের বাইরের এলাকার জন্য বেশি প্রযোজ্য। দ্বিতীয়ত, শহরেদের ক্ষেত্রে বিভাজনটা কমানো প্রয়োজন। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটা খুবই জরুরি। তৃতীয়ত, পরিকল্পনা বাস্তবতার আলোকে ও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখে তৈরি করতে হবে। এখানে পশ্চিমা ধারণার প্রভাব কমাতে হবে। পরিকল্পনাগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়নের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। চতুর্থত, ঢাকা শহরকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। মানুষের মাঝে রাজধানীমুখী হওয়ার প্রভাব না কমাতে পারলে শুধু ঢাকা নয় খুলনাসহ অন্যান্য শহরগুলোর সমস্যা দূর হবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close