reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১২ জানুয়ারি, ২০২২

মেয়রের উন্নয়ন ভাবনা

স্বনির্ভর নগর গড়ব

পাহাড়-নদীবেষ্টিত চেঙ্গী বিধৌত গিরিনন্দিনী খাগড়াছড়ি পৌরসভা। এটি একটি পর্যটনবান্ধব পৌর শহর। এরই মধ্যে নান্দনিক, পরিচ্ছন্ন ও আধুনিক পৌর নগরী হিসেবে সারা দেশে সমাদৃত হয়েছে খাগড়াছড়ি। তবে সংকটও আছে। এই পৌরসভা নিয়ে আমার অনেক ভাবনা আছে। অতীতের সব সংকট কাটিয়ে এটিকে আরো আধুনিক এবং স্বনির্ভর পৌর নগর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছি। প্রতিদিনের সংবাদকে কথাগুলো বলছিলেন খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি শংকর চৌধুরী।

১৩.০৫ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে ১৯৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘গ’ শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে সূচিত হয় খাগড়াছড়ি পৌরসভা। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে অবস্থান এই পৌরসভাটির। ১৯৯৪ সালের ১ জুলাই ‘খ’ শ্রেণিতে এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালের ১৮ এপ্রিল ‘ক’ শ্রেণিতে উন্নীত হয় এটি। ৯টি ওয়ার্ডে এই পৌরসভার বর্তমান জনসংখ্যা ৭১ হাজার ২৫০ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩৭ হাজার ৫১৬ জন এবং মহিলা ৩৩ হাজার ৭৩৪ জন। এই পৌরসভায় শিক্ষার হার ৮৬.০১ শতাংশ।

পৌরসভার সপ্তম পরিষদের মেয়র হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী। প্রথমবারের নির্বাচনেই বাজিমাত করেন তিনি। গত বছরের ১৬ জানুয়ারির নির্বাচনে দুইবারের বিদ্রোহী মেয়র রফিকুল আলমকে হারিয়ে নির্বাচিত হন খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা। এরপর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন ১৭ ফেব্রুয়ারি।

মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী বলেন, আমাদের কিছু সংকট ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। খাগড়াছড়ি পৌর শহরের সৌন্দর্য বিনষ্টের প্রধান অন্তরায় হলো এখানকার পরিবহন টার্মিনাল। বহু বছর আগে যেনতেনভাবে টার্মিনালটি স্থাপন করা হয়েছিল। একে তো আয়তনে ছোট তার ওপর দীর্ঘবছর ধরে সীমানা প্রাচীরবিহীন হযবরল অবস্থায় পড়ে আছে খাগড়াছড়ি পৌর পরিবহন টার্মিনালটি। এতে করে যত্রতত্র পার্কিংয়ের ফলে নষ্ট হচ্ছে শহরের সৌন্দর্য। সরকারের কাছে একটি আধুনিক পরিবহন টার্মিনাল নির্মাণের বরাদ্দ পেতে আবেদন করেছি। বরাদ্দ সাপেক্ষে এই টার্মিনালটি আবার নির্মিত হলে খাগড়াছড়ি হবে পরিপূর্ণ একটি গোছালো শহর।

বিদ্যুৎ, সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা সম্পর্কে মেয়র বলেন, খাগড়াছড়ি পৌর শহরে ৭৩ দশমিক ৩০ কিলোমিটার কাঁচা ড্রেন, ২০ দশমিক শূন্য ১ কিলোমিটার পাকা ড্রেন, ২৫ দশমিক ২৮ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা, ২৫ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার আধপাকা রাস্তা, ৯৭ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৫৭টি ব্রিজ ও ১৩৪টি কালভার্ট রয়েছে। তবে দিন দিন এ শহরে বসতি বাড়ছে। জনসংখ্যার অনুপাতে আরো অনেক নতুন ড্রেন এবং সড়ক নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যদিও এক্ষেত্রে প্রধান সংকট হলো ফান্ড। হাট-বাজার ইজারা থেকে শুরু করে এখানকার সব জলমহালগুলোও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কারণে পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে ন্যস্ত। ফলে আমরা শুধু সীমিত রাজস্ব আয়ের ওপরই নির্ভরশীল। আমাদের সীমিত আয়ে পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়ার পর উন্নয়ন করার মতো তেমন কোনো ফান্ড আর অবশিষ্ট থাকে না। সে কারণে হাজার চেষ্টা করলেও সরকারি এবং দাতা সংস্থার সহযোগিতা ছাড়া এই পৌর শহরকে আধুনিক ও সৌন্দর্যবর্ধন করা অসম্ভব প্রায়।

এছাড়া খাগড়াছড়ি পৌর শহরে পর্যাপ্ত সড়কবাতি রয়েছে। তবে অভ্যন্তরীণ কিছু কিছু এলাকায় প্রতিবন্ধকতাও আছে। পৌরসভার ২নং, ৬নং ও ৯নং ওয়ার্ডে কিছু কিছু অংশ পাহাড়ি এলাকা। এ এলাকাগুলোতে বৈদ্যুতিক বাতি স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে এসব এলাকায় আমরা সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একটি প্রকল্প প্রেরণ করেছি। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে আমরা ওইসব এলাকায় সোলারের মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করব।

চলমান উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কে মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী বলেন, পূর্ববর্তী পরিষদের সময় থেকেই ইউজিপ-৩ প্রকল্প চলমান ছিল। কোভিড-১৯ এর কারণে ওই প্রকল্পের মেয়াদ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছিল। সদ্য গত হওয়া বছরটিতে আমরা ওই প্রকল্পের অধীনে উন্নয়ন কাজ করেছি। এছাড়া পৌর শহরের বাজার এবং অলিগলির সড়কগুলোও এতদিন বেশ নাজুক অবস্থায় ছিল। পৌরসভার অর্থায়নে এবং অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে সম্প্রতি টেন্ডার আহ্বান করেছি। আশা করি শিগগিরই এই দুর্ভোগ নিরসন হবে।

খাগড়াছড়ি পৌর শহরের প্রধান সড়কের মাঝখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে স্থাপিত বিলবোর্ড প্রসঙ্গে পৌর মেয়র বলেন, পূর্ববর্তী মেয়রের সময়ে এই বিলবোর্ড অপরিকল্পিতভাবে স্থাপন করা হয়েছিল। শহরের প্রধান সড়কটিতে রাস্তার উন্নয়ন কাজ চলমান রয়েছে। কাজ শেষ হলে চেঙ্গী স্কোয়ার থেকে ভাঙ্গাব্রিজ পর্যন্ত যতগুলো বিলবোর্ড রয়েছে সেগুলো অপসারণ করা হবে। এছাড়া পূর্ববর্তী পৌর পরিষদ বা মেয়র সড়কের পাশে সাইকেল লাইন করেছিলেন। আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর টিএলসিসির সব সদস্য এবং সচেতন নাগরিকদের মতামতের ভিত্তিতে সাইকেল লাইন অপসারণসহ রাস্তা প্রশস্ত করেছি। পাশাপাশি রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার দিয়ে এ শহরের সৌন্দর্যবর্ধন এবং দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নিয়েছি।

ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কী না এমন প্রশ্নে খাগড়াছড়ি পৌর মেয়র বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত এসব যান বন্ধে এরই মধ্যে আদালত কর্তৃক নির্দেশনা এসেছে। তবে আমাদের এই পাহাড়িয়া শহরে এর বিকল্প কোনো বাহনও নেই। এখানকার অধিকাংশ এলাকায় রিকশায় করে যাতায়াত প্রায় অসম্ভব বলা চলে। বিশেষত স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থী, সরকারি- বেসরকারি চাকরিজীবী ও কৃষিপণ্য পরিবহনে আপাতভাবে ইজিবাইক ব্যতীত ভিন্ন কোনো উপায় নেই সাধারণ মানুষের। পৌরসভা থেকে নিবন্ধিত ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক থাকলেও সংখ্যা দেড় হাজার হলেও অনিবন্ধিত রয়েছে আরো প্রায় তিন থেকে চার হাজার ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। অর্থাৎ এ শহরে প্রায় পাঁচ হাজারেরও অধিক মানুষ ইজিবাইক চালানো পেশায় জড়িত। অনেকে আবার ধার-দেনা করে, লোন নিয়ে ইজিবাইক কিনে তা দিয়ে সংসার চালাচ্ছে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে আমরা এ শহর থেকে এখনই ইজিবাইক উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তবে চলাচল যেন সীমিত আকারে হয় সেদিকে আমরা খেয়াল রাখছি। পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়াতে ইজিবাইকের ডানপাশ বন্ধ এবং চালকদের নির্ধারিত একটি ড্রেসকোড পরিধানেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর এক্ষেত্রে চালকদেরও অবশ্যই ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে হতে হবে। আশা করি শিগগিরই এই নির্দেশনা কার্যকর হবে। খাগড়াছড়ি পৌরবাসীর প্রাণের দাবি ‘শিশুপার্ক’ নির্মাণ প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, আমরাও চাই আমাদের কোমলমতি শিশুরা একটি সুন্দর ও বিনোদনপূর্ণ শৈশব অতিবাহিত করুক। পৌরবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি হলেও এক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক সংকটই মূল বাধা। পৌরসভার নিজস্ব ভূমি নেই, ফলে শিশু পার্ক নির্মাণ করতে হলে আগে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। আর এই ভূমি অধিগ্রহণ অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। কিন্তু খাগড়াছড়ি পৌরসভার তেমন কোনো আয়ের উৎস নেই, ফলে ব্যয়বহুল এই প্রকল্প প্রণয়ন করা পৌরসভার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সব সরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রেখেছি। কোনোভাবে পার্কের জন্য জায়গা বের করতে পারলে তবে একটি সুন্দর শিশুপার্ক প্রতিষ্ঠা করব।

পর্যটকদের সেবা নিশ্চিত করার প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, পৌর মার্কেটের পাশেই পর্যটকদের জন্য শৌচাগার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া তারা যেন কোনো ধরনের বিড়ম্বনায় না পড়েন সে লক্ষ্যে একটি হেল্প ডেস্ক চালুরও উদ্যোগ নিয়েছে পৌর কর্তৃপক্ষ। পর্যটকদের সব ধরনের সহায়তা প্রদানের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে এই ডেস্কে নিযুক্ত থাকবে পৌরসভার প্রতিনিধি। এছাড়া ওই ডেস্কে মোবাইল ফোন চার্জ দেওয়ারও ব্যবস্থা থাকবে। পর্যটনবান্ধব এই শহরে পর্যটকরা যেন নির্বিঘেœ ভ্রমণ করতে পারে সেজন্য তৎপর রয়েছি। পর্যটকদের সেবা দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। এছাড়া পৌর এলাকাকে মাদকমুক্ত করতে এলাকাভিত্তিক সচেতনতা কার্যক্রম চলছে। প্রকৃত দুস্থরা যাতে বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধীভাতাসহ বিভিন্ন অনুদান সঠিকভাবে পায় সেজন্য সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলর এবং টিএলসিসির সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত মনিটরিং করছি। শহরের ময়লা-আবর্জনা যেন সঠিক জায়গায় ফেলা হয় এ ব্যাপারে পৌরবাসীকে উৎসাহিত করছি। দিনের বেলা মালবাহী ট্রাক ও ভারী যানবাহন যেন শহরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close