নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১১ জানুয়ারি, ২০২২

সুসম্পর্ক চায় পাকিস্তান

আগে ক্ষমা চাইতে হবে-মন্তব্য মোমেনের

স্বাধীনতার ৫০ বছরের মাথায় এসে সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের। এই দাবি করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি। অতীত ভুলে দেশ দুটি সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশাও তার। তবে বাংলাদেশ বলেছে আগে চাইতে হবে ক্ষমা। এক দশক ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ভয়াবহ টানাপড়েনের পর ২০২০ সাল থেকে শুরু হয় উল্টো স্রোত। হঠাৎ করেই বাংলাদেশকে কাছে টানতে চাচ্ছে পাকিস্তান। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুবার দেখা করেন ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী। আর সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গেও ফোনালাপ হয় বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের। এ সময় তারা একে অন্যকে দেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণও জানান।

সম্প্রতি ইসলামাবাদে সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি দাবি করেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের বরফ গলছে। অতীত ভুলে এই সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি।

শাহ মেহমুদ কুরেশি জানান, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান কথা বলেছেন। শেখ হাসিনাকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। ইমরান খানেরও বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ নিয়ে কথা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের বরফ গলছে। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুুল মোমেন জানান, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ইস্যুতে আগে ক্ষমা চাইতে হবে পাকিস্তানকে। এ বছরই ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন হবে পাকিস্তানে। সেখানে বাংলাদেশের অংশ নেওয়ার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

এদিকে, কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রকাশ্য অবস্থান এবং বিচারের বিরোধিতা করায় দুই দেশের সম্পর্ক একবারে তলানিতে রয়েছে।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে, এমনটিই ধারণা পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক বাংলাদেশের হাইকমিশনার সোহরাব হোসেনের।

সোহরাব হোসেন বলেন, বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পাকিস্তানের বিরোধিতার পর সেই অবস্থা আরো বেশি খারাপ হয়েছে।

দুই দেশের মধ্যে যেটুকু সম্পর্ক আছে সেটাকে ‘ওপরে ওপরে’ বলে মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গবেষক আফসান চৌধুরী। তার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে তো পাকিস্তানের কোনো সম্পর্কই নেই। বিশেষ করে ’৭১ এর পরে এই সম্পর্ক গাঢ় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমাদের প্রজন্ম যত দিন থাকবে তারা তো ৭১ এর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকবে। বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো হবে না, খারাপও হবে না। সম্পর্ক ভীষণ খারাপ হওয়া থেকে একটু কম খারাপ হতে পারে কিন্তু ভালো হবে না।

বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সম্পর্ক কেমন সেটিও বেশ প্রভাব বিস্তার করে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

একদিকে যেমন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে বলে পরিচিতি রয়েছে, ঠিক তার বিপরীতে ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র হচ্ছে পাকিস্তান। এই ত্রিমুখী সম্পর্ক বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আফসান চৌধুরী বলেন, আমাদের যে দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যার সঙ্গে ওঠাণ্ডবসা বেশি, আবার পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক। ভারতের সামনে পাকিস্তান কোনো শক্তিই না, তবে সমস্যা হচ্ছে পাকিস্তানের সঙ্গে চীন রয়েছে। চীন চেষ্টা করছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে যে ভারতবিরোধিতা রয়েছে সেটাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এক রকম, আবার ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক আরেক রকম। চীনের বিষয়ে বাংলাদেশ-পাকিস্তান এক মেরুতে থাকলেও ভারতের সঙ্গে সে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই দুটি দেশ বিপরীত মেরুতে রয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক নয় বরং দ্বন্দ্ব রয়েছে।

বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব রয়েছে চীনের। আর পাকিস্তানের সমর্থনে রয়েছে চীন। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশেরও সুসম্পর্ক চলছে।

এই পরিস্থিতি পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক গভীর করতে পারে কি এমন প্রশ্নে

আফসান চৌধুরীর বক্তব্য, ‘হবে না। কারণ, পাকিস্তানকে আসলে আমাদের কোনো দরকার নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে ট্রেড হবে না। আমাদের ট্রেড স্বাভাবিকভাবেই হবে ভারতের সঙ্গে।’ পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য নাই, পড়তে যাই না, অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্যও যাই না। তাহলে সম্পর্ক উন্নয়ন করে লাভ কী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুকসানা কিবরিয়া বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই চেয়েছে যে পাকিস্তান তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাক। কিন্তু পাকিস্তান সেটা কখনো করেনি। ১৯৭৪ সালে সিমলা চুক্তির পর যে আলোচনা শুরু হয়েছিল তাতে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, আর বাংলাদেশ এবং ভারত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের ফেরত পাঠানো শুরু করে। এই ঘটনার কারণেই পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে এবং দেশটির কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিল।

এক ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় সবার সম্মতিতে যে চুক্তি হয়, তাতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। চুক্তির বিবরণ অনুযায়ী, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা তাদের (পাকিস্তানকে) ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান। তবে বাংলাদেশ বলে যে, ওই ক্ষমা চাওয়া যথাযথ হয়নি। ওরা দুঃখ প্রকাশ করেছিল, ক্ষমা চায়নি, বলেন আফসান চৌধুরী। ভুট্টো দুঃখ প্রকাশ করেছিল। কারণ ওদের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ ছিল না। এটা ছিল ইন্ডিয়া। ইন্ডিয়া বলেছিল যে তুমি অন্তত কিছু বল, তা না হলে আমরা তোমার সঙ্গে কী করব।

আফসান চৌধুরীর মতে, একাত্তরের এর যুদ্ধটা আমাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হলেও সেটা ভারত কিংবা পাকিস্তান কারো জন্যই মুক্তিযুদ্ধ ছিল না। পাকিস্তানের পক্ষে মাফ চাওয়া সম্ভব না। কারণ মাফ চাইতে হলে সেনাবাহিনীর হয়ে মাফ চাইতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close