কাজী আবুল মনসুর, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন
রেজাউল না কি শাহাদাত
আগামীকাল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও সাধ্যমতো মাঠ চষে বেড়িয়েছেন প্রার্থীরা। শেষ মুহূর্তে ভোটের মাঠ জরিপে কে হচ্ছেন চট্টগ্রামের মেয়র তা নিয়ে চলছে আলোচনা। তবে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী, নয়তো বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেনের মধ্যে একজন নির্বাচিত হবেন তা প্রায় নিশ্চিত। কাগজে কলমে মেয়র পদে ৭ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও নৌকা আর ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যেই লড়াই হবে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, চসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান ২ দলের প্রার্থীসহ ৭ প্রতিদ্বন্দ্বী। এছাড়া ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৭২ এবং ১৪টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৫৭ কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এবার ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ ভোটার তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ভোটারদের মধ্যে পুরুষ ৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৩ এবং মহিলা ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৭৩ ভোটার।
এদিকে প্রশাসক হিসেবে নগরবাসীর মন জয় করেছেন নগর আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজন। গত কয়েক বছরে যা হয়নি মাত্র ৬ মাসে তা অনেকাংশে করে দেখিয়েছেন তিনি। প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সময় তিনি বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তাকে যতটুকু সময়ের জন্য প্রশাসক হিসেবে নিয়ে দিয়েছেন তার মর্যাদা তিনি রাখবেন।’ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর মেরামত থেকে শুরু করে নালা-খালে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে তিনি কথা রেখেছেন।
প্রতিদিনের সংবাদকে খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘আমি প্রশাসক ছিলাম না, ছিলাম নগরবাসীর সেবক। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অল্প সময়ের মধ্যে সিটি করপোরেশন দুর্নীতিমুক্ত করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় আমার চেষ্টা ছিল। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক আর খাল-নালাগুলোর বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার চ্যালেঞ্জ ছিল। করপোরেশনের ফান্ডে রয়েছে টাকার অভাব। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে আমি চেষ্টা করেছি যাতে নগরবাসীর সমস্যা কিছুটা লাঘব হয়।’
চসিক নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগ মমোনিত এম রেজাউল করিম চৌধুরী, বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন ‘ধানের শীষ’, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের এম এ মতিন ‘মিনার’, ‘আম’ নিয়ে এনপিপির আবুল মনজুর, ‘চেয়ার’ প্রতীকে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ, ‘হাতপাখা’ নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. জান্নাতুল ইসলাম এবং ‘হাতি’ প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন খোকন চৌধুরী।
এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম পেশায় একজন ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন নগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত তিনি। এক সময় নগর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও মনোনয়ন পাওয়ার আগে দীর্ঘসময় এর দূরে ছিলেন। বিভিন্ন সময় মেয়র বা সংদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়ে অভিমানে দূরে সরে যান বলে জানান তার সমর্থকরা। তবে চসিক নির্বাচনে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তার নাম ঘোষণার পর সক্রিয় হয়ে উঠেন রেজাউল। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে রেজাউল করিমের মনোনয়ন পাওয়া অবাক অনেকেই। আ জ ম নাছির উদ্দিনকে পুনরায় মনোনয়ন পাওয়ার গুঞ্জন ছিল। শেষ পর্যন্ত সিটি মেয়রের পদটি আওয়ামী লীগ নেতার হাতে রাখার জন্য রেজাউলকে জয়ী করতে মাঠে নেমেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা।
অপরদিকে বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন পেশায় চিকিৎসক ডাক্তার। দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ডা. শাহাদাতের বিরুদ্ধে রয়েছে ৪৮টি মামলা। এর মধ্যে দুটি স্থগিত, দুটি তদন্তাধীন, একটি থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি। বাকি ৪৪টি বিচারাধীন। সব মামলাই ‘রাজনৈতিক কারণে’ বলে বিএনপির মন্তব্য। মেয়র পদে এক সময় বিএনপির মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও এম মনজুর আলম মনজু নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন তিনি হারানো গৌরব পুনার্জনে জন্য লড়ছেন বিএনপি।
চসিক সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল সর্বশেষ চসিক নির্বাচন হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট এর মেয়াদ শেষ হয়। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা ছিল। সে হিসাবে ২৯ মার্চ এই সিটির ভোট হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল নির্বাচন কমিশনের। করোনার কারণে সময়মতো নির্বাচন না হওয়ায় প্রশাসক নিয়োগ করে সরকার। প্রশাসকের মেয়াদকালেই ২৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন ঠিক করে ইসি।
সূত্র জানায়, ১৮৬৩ সালের ২২ জুন ‘চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি’ গঠিত হয়। ১৯৮৪ সালে প্রশাসন ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৮ জন কমিশনারের সমন্বয়ে পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৯০ সালের ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের নাম বদলে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন’ নামকরণ করা হয়। তখন মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরীকে মেয়র নিযুক্ত করে সরকার।
পরে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের ১২ মে মনোনীত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পান বিএনপি নেতা মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন। তিনি ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার ওমর ফারুককে সিটি করপোরেশনের প্রশাসক হিসেবে ২১ ডিসেম্বর থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯৩ সালের ১১ মার্চ প্রথম নির্বাচিত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেন আওয়ামী লীগের এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ২০০৫ সালের নির্বাচনে পুনরায় মেয়র হন তিনি। পরবর্তিতে ২০১০ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে মনজুর আলম মনজু মেয়র পদে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে হারিয়ে পরাজিত করেন। তবে ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের জন্য মেয়র পদটি ফিরিয়ে আনেন আ জ ম নাছির উদ্দীন।
আগামীকালের ভোটের লড়াই নির্ধারণ করবে কে হবেন পরবর্তী মেয়র। নির্বাচনে যে দলেরই জয় হোক, মেয়রকে একজন সেবক হিসেবে কাছে পেতে চান চট্টগ্রামবাসী ।
"