আরফাতুল মজিদ, কক্সবাজার

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২১

দখল-দূষণের কবলে কোহেলিয়া নদী

* বন্ধের পথে নৌ-চলাচল * হুমকিতে লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা

কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় কালারমারছড়া ও মাতারবাড়ী-ধলঘাটার মাঝখান অবস্থিত কোহেলিয়া নদী। যুগ যুগ ধরে জোয়ার-ভাটায় আপন গতিতে ভরা যৌবনে প্রবাহিত হতো কোহেলিয়ার স্রোত। সম্প্রতি কক্সবাজারের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়ার পথে এ নদী। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগে এই নদী হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছেন ঠিকাদাররা। এতে একসময় নদীতে চলাচল করা কয়েক হাজার মণের লবণের বোট চলাচল করলেও এখন সাধারণ নৌযান চলাচলই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, যেকোনো কারণে কোহেলিয়া নদী মারা গেলে এখানকার শত শত জেলে এবং লবণচাষি ও ব্যবসায়ীর জীবন হুমকির মুখে পড়বে। পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা উল্লেখ করে এই পরিবেশকর্মী আরো বলেন, কোহেলিয়া নদীর আশপাশে চলমান অপরিকল্পিত ভরাট ও দখল প্রক্রিয়া অবিলম্বে বন্ধ করাসহ নদীর সীমানা নির্ধারণ করে তা উদ্ধার করা উচিত।

কোহেলিয়া নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক আবুল বশর পারভেজ বলেন, কোহেলিয়া যেভাবে দ্রুত ভরাট হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যথাবিহিত ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই হারিয়ে যাবে এ নদী। তাই নদীটি খননের ব্যবস্থা করে জেলেদের মাছ ধরার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মহেশখালীতে দেশের বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য মাতারবাড়ীর দক্ষিণে ১ হাজার ৪১৪ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছে সরকার। বর্তমানে সেখানে মাটি ভরাট করে প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এইসব প্রকল্পের বিভিন্ন বর্জ্য ও মাটি পাইপের মাধ্যমে সরাসরি কোহেলিয়াতে ফেলে দিন দিন ভরাট হচ্ছে নদীটি।

অপর দিকে প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের জন্য নদী ভরাট করে মাতারবাড়ী সেতু থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩০০ ফুট প্রস্থ বিশাল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এই সকড়টি নির্মাণের দায়িত্বে পায় মীর আকতার হোসেন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এতে দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে কোহেলিয়া। ফলে নদীতে চলাচলকারী ইঞ্জিনচালিত লবণের বোট ও বিভিন্ন ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পলি মাটি নদীর পানির সঙ্গে মিশে পানি ঘোলাটে হয়েছে। দূষিত হওয়ায় নদীর দুই পাশে প্রায় অর্ধশত চিংড়ি মাছের প্রজেক্টে মাছ মারা যাচ্ছে। এ কারণে লোকসান গুনতে হচ্ছে শতকোটি টাকার চিংড়ি প্রজেক্টের ইজারাদারদের।

স্থানীয় জেলে সাইফুল ইসলাম জানান, এ নদীর ওপর কয়েক হাজার পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু নদী দিন দিন ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় জেলেদের জালে আগের মতো তেমন আর ধরা পড়ছে না সামুদ্রিক মাছ। ফলে বেকারত্ব ও অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছে হাজারো অধিক জেলে পরিবার। লবণচাষি জহির আলম জানান, কোহেলিয়া ভরাটের কারণে পূর্ণ জোয়ারেও এখন বড় ও মাঝারি লবণ বোটসহ বিভিন্ন ইঞ্জিনচালিত নৌযান চলাচল করতে পারছে না। আগে এ নদীতে দেখা যেত পাঁচ হাজার মণ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন লবণের বোট চলাচল করত। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন পেশার মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল এ নদীর মাছ, কাঁকড়া ও লবণ। কোহেলিয়া হারিয়ে যাওয়া মানে মহেশখালীর প্রায় লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস হয়ে যাওয়া।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, মহেশখালীর কোহেলিয়া নদীসহ কক্সবাজারের সব নদী নিয়ে আমাদের বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে কোনো নদী দখল বা দূষণ হবে না। নদী নদীর মতো থাকবে। নদীর বিষয়ে আগামীতে আমাদের একটা মিটিং রয়েছে, এরপরেই বিস্তারিত বলা যাবে।

লবণচাষিরা জানান, নদীতে জেগে ওঠা চরগুলো একের পর একে দখল করে নিচ্ছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী। তারা প্রথমে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের তৈরি করে। তারপর নদীর চর অবৈধভাবে দখল করে নেন। ফলে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে কোহেলিয়া। অন্যদিকে মাতারবাড়ী সেতুর উত্তর পাশে নদীতে ড্রেজার বসিয়ে গর্ত করে বালু বিক্রি করছে এক শ্রেণির বালু দস্যুরা। এতে মাতারবাড়ীর একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম সেতুটি হুমকির মুখে রয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close