আরিফ খান, বেড়া-সাঁথিয়া (পাবনা)

  ২২ জানুয়ারি, ২০২১

বাঘাবাড়ী নৌবন্দর

যমুনায় নাব্যতা সংকট আটকা ৩০ জাহাজ

* ছোট নৌযানে পণ্য পরিবহনে ব্যয় বৃদ্ধি * কাজ না পেয়ে শ্রমিকরা বেকার

যমুনায় নাব্য সংকটের কারণে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ ভিড়তে সমস্যা হচ্ছে। এ বন্দরে প্রতিদিন যেখানে ১২ থেকে ১৫টি জাহাজ ভিড়ে, কয়েক সপ্তাহ ধরে সেখানে দু-তিনটি জাহাজ ভিড়ছে। এদিকে এক সপ্তাহে নাব্য সংকটে আরিচা থেকে বাঘাবাড়ী নৌবন্দর পর্যন্ত আট পয়েন্টে আটকে আছে ৩০ জাহাজ। এতে বন্দরের এক হাজার শ্রমিকের মধ্যে ৪ শতাধিক বেকার হয়ে পড়েছেন।

নৌবন্দরে কর্মরত শ্রমিকরা জানান, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার বেশির ভাগ সার সরবরাহ হয় বাঘাবাড়ী নৌবন্দের মাধ্যমে। এ ছাড়া তেল, সিমেন্টের ক্লিংকার, কয়লা ও পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এ বন্দরে ভিড়ে জাহাজ। প্রতি বছর এ সময়ে পণ্যবাহী জাহাজের ভিড়ে সরগরম থাকে এই নৌবন্দর। এবার জাহাজ কমে যাওয়ায় নৌবন্দর এলাকা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে পড়েছে। তারা জানান, নদীতে পানি কমে গেছে, জেগেছে ডুবোচর। এসব কারণে জাহাজ বন্দরে ভিড়তে সমস্যা হচ্ছে।

বিআইডব্লিউটিএর সহকারী পরিচালক ও বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের পোর্ট অফিসার সাজ্জাদ রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘এই নৌপথের বাঘাবাড়ী থেকে আরিচা পর্যন্ত অংশে আমাদের মৌসুমের শুরু থেকেই তিনটি ড্রেজার কাজ করে চলেছে। গত ডিসেম্বরের শেষদিকে নাব্য সংকট দেখা দিয়েছিল ড্রেজিং করে সমস্যা সমাধান করা হয়েছিল। নদীতে দ্রুত পানি নেমে যাওয়ায় আবার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এখন মোট চারটি ড্রেজার কাজ করছে। আশা করছি, আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে এ সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। তবে বেশির ভাগ জাহাজই ১০-১২ ফুট ড্রাফট নিয়ে বন্দরে আসছে, যে কারণেই সমস্যা বেশি হচ্ছে।’

বন্দর-সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্তাব্যক্তি জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর থেকেই বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে অচলাবস্থা শুরু হয়। একপর্যায়ে বন্দরে কর্মরত এক হাজার শ্রমিকের মধ্যে প্রায় সবাই বেকার হয়ে পড়েন। পরে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক হলেও শ্রমিকদের বড় একটি অংশ বেকারই থেকে যান। শ্রমিকসহ বন্দর-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভেবেছিলেন, বোরো মৌসুম সামনে রেখে চলতি বছরের শেষদিকে নৌবন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে শ্রমিক তদারকির দায়িত্বে থাকা বন্দরের শ্রমিক সরদার ওহাব আলী জানান, কম জাহাজ ভেড়ায় নৌবন্দরের তিন ভাগ শ্রমিকের মধ্যে দুভাগ শ্রমিকই বেকার। যারা কাজ করছেন, তারা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় অর্ধেক মজুরি পাচ্ছেন। এ অবস্থায় চরম দুরবস্থায় দিন কাটছে শ্রমিকদের। সব মিলে বন্দরটি স্থবির হতে বসেছে।

বন্দরের ঘাট ইজারাদার আব্দুস সালাম প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, বছরের এ সময়েই সবচেয়ে বেশি জাহাজ নৌবন্দরে ভেড়ার কথা। অথচ যমুনায় নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে গত এক সপ্তাহে বেড়া উপজেলার পেঁচাকোলা, মোহনগঞ্জ, কাজিরহাটসহ বিভিন্ন স্থানে আটকে যাওয়া চারটি জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পেরেছে।

প্রতিদিন দু-তিনটির বেশি জাহাজ নৌবন্দরে ভিড়তে পারছে না। যে জাহাজগুলো ভিড়ছে, সেগুলোকে নৌবন্দরের ৪০-৫০ কিলোমিটার আগে প্রায় অর্ধেক পণ্য ছোট নৌযানে খালাস করে ভিড়াতে হচ্ছে। এতে পণ্য পরিবহনের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পরিবহন ঠিকাদাররা পণ্য খালাসে নগরবাড়ী ঘাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নৌঘাট বেছে নিচ্ছেন। ফলে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরটিতে জাহাজের সংখ্যা কমে গেছে।

এভিএম ফয়সাল-এর চালক আব্দুল হালিম এই প্রতিনিধিকে জানান, পণ্যবোঝাই জাহাজগুলো আরিচা পর্যন্ত নির্বিঘেœ আসতে পারছে। এরপর বেড়া উপজেলার নতিবপুর, ব্যাটারিরচর, নাকালিয়া, পেঁচাকোলা ও মোহনগঞ্জে এসে বিপদে পড়ছে। এসব স্থানে যমুনার গভীরতা ৭-৮ ফুটে নেমে এসেছে। অথচ পণ্যবোঝাই জাহাজ চলাচলের জন্য কমপক্ষে ১০ ফুট গভীরতার প্রয়োজন। তাই জাহাজগুলোকে দৌলতদিয়ায় নোঙর ফেলে ট্রলারসহ বিভিন্ন ছোট নৌযানে আংশিক পণ্য খালাস করে তারপর নৌবন্দরে আসতে হচ্ছে। এতে একদিকে পরিবহন ব্যয় যেমন বাড়ছে; তেমনি সময়ও লাগছে বেশি।

গতকাল বুধবার বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, তিন-চারটি জাহাজ ভিড়ে আছে বন্দরে। এর সঙ্গে ভিড়ে আছে চার-পাঁচটি সারভর্তি ছোট নৌযান। সেগুলো থেকে শ্রমিকরা সার নামাচ্ছেন, তাদের সংখ্যা দেড়শ। অথচ অন্যান্য বছর এ সময়ে সারা দিন ৫০০-৬০০ শ্রমিককে কাজ করতে দেখা গেছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

গতকাল বেড়া উপজেলার নাকালিয়া বাজার ও পেঁচাকোলা গিয়ে দেখা যায়, ২০টি জাহাজ যমুনার ডুবোচরে আটকা পড়েছে। এ ছাড়া রাজধরদিয়া, চরশিবালয় ও নাকালির চরে বিভিন্ন পয়েন্টে আরো ১০ জাহাজ আটকে থাকার তথ্য জানা গেছে। ওইসব কার্গোজাহাজ রাসায়নিক সার, কয়লা, গম ও চাল নিয়ে বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে যাচ্ছিল।

বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অফিসে যোগাযোগ করা হলে মোবাইল ফোনে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, রাসায়নিক সার ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য পানির গভীরতা ১০-১১ ফুট দরকার হয়। কিন্তু বর্তমানে এ নৌপথে কোথাও কোথাও গভীরতা ৮-৯ ফুট। বাঘাবাড়ী নৌবন্দর থেকে দৌলতদিয়া পর্যন্ত নৌপথের চরসাফুল্লা, নাকালিয়া, নাকালী, রাজধরদিয়া, নগরবাড়ীসহ আট পয়েন্টে নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে। এই সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করছে।

গত শনিবার থেকে গতকাল বুধবার দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে ডুবোচরে ৩০টি পণ্যবাহী জাহাজ আটকা পড়েছে। ড্রেজিং করার পর গত তিন দিনে আটকে পড়া চারটি জাহাজকে চলার পথ করে দেওয়া গেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close