আল-মামুন বিশ্বাস, গোমস্তাপুর (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২১

স্কুলপড়ুয়ার আনন্দ মুদ্রা সংগ্রহে

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর পৌরসভার জালিবাগান মহল্লার মোবারক হোসেনের ছেলে মাহির ইয়াসির, সে রহনপুর এবি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। সে ১২০টি দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করেছে। তার নেশা বিভিন্ন দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করা। প্রাচীন মুদ্রা এবং ঐতিহসিক ঐতিহ্য সংগ্রহ করে আনন্দ-উল্লাস করেন এই স্কুলপড়ুয়া।

মাহি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার বাবা নতুন বাড়িতে উঠেন। বাড়ির আসবাবপত্র পরিবর্তন করার সময় বাড়িতে থাকা প্রাচীন একটা সিন্দুক দেখতে পায় সে। সিন্দুকটি খুলতে পরিবারকে চাপ দেয়। এর ভেতরে কী আছে দেখবে। কিন্তু ওই সিন্দুকটির চাবি পরিবারের সদস্যরা কেউ খুঁজে পাচ্ছিল না। পরে তার বাবা সিন্দুকটির তালা ভেঙে ফেলেন। সিন্দুকের ভেতর দেখতে পায় ২৪টি ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন শাসকের রৌপ্য মুদ্রা এবং ৮০ থেকে ৯০টি তাম্র মুদ্রা। মুদ্রাগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের ছিল। সেগুলো সংগ্রহ করে সিন্দুকের ভেতরে রাখা ছিল। ওই মুদ্রাগুলো দেখার পর থেকেই, মুদ্রা সংগ্রহের একটা আগ্রহ জন্মায় মাহির ইয়াসিরের মাঝে। তার বাবা মোবারকের কাছে মুদ্রাগুলো নিবে বলে আবদার করছিল, প্রথমে তাকে দিতে রাজি হয়নি তার বাবা, কারণ সে তখন অনেক ছোট ছিল। পরবর্তী সময়ে সে বাইরে থেকে কিছু মুদ্রা সংগ্রহ করতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে মুদ্রা সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে উঠে। সামান্য সময়ের ব্যবধানে সে পাঁচ থেকে ছয়টি দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করে। মুদ্রা সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ দেখে তার বাবা ওই প্রাচীণ মুদ্রাগুলো তাকে দিয়ে দেয়। এ থেকেই তার মুদ্রা সংগ্রহের জগতে যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ৯ বছরে তার সংগ্রহে ১২০টির অধিক দেশের প্রায় দুই হাজার মুদ্রা রয়েছে। এর মধ্যে বিরল মুদ্রাও রয়েছে। এ ছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে প্রথম সারির নোট, অপ্রচলিত নোট ও ধাতব মুদ্রা। রয়েছে পাকিস্তান আমলের বিভিন্ন ধরনের নোট এবং ধাতব মুদ্রা।

মাহির এ শখের কথা জানতে পেরে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের কাছে থাকা মুদ্রাগুলো তাকে দিয়ে দেয়। এমনকি পরিচিত কেউ বিদেশে আছে তারাও অবস্থানরত ওই দেশসহ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা সংগ্রহ করে তাকে দিয়ে থাকে। মাহির কাছে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় ৩০টি বিলুপ্ত সাম্রাজ্যের মুদ্রা রয়েছে। যার সংখ্যা প্রায় তিন শতাধিক। গান্ধারা সাম্রাজ্যের মুদ্রা, হরিকেলা সাম্রাজ্যের মুদ্রা, মৌর্য আমলের সম্রাট অশোকের শাসনামলের মুদ্রা, গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজা কুমার গুপ্তের মুদ্রা, সুসং রাজ্যের রাজা অগ্নিমিত্রের মুদ্রা, নাগা সাম্রাজ্যের রাজা গণপতি নাগের মুদ্রা, কুশান সাম্রাজ্যের রাজা বাসুদেবের মুদ্রা, প্রাঞ্চালা সাম্রাজ্যের রাজা ইন্দ্র মিত্রের মুদ্রা, পাল সাম্রাজ্যের রাজা দেবপালের মুদ্রা, চোলা সাম্রাজ্যের রাজা চোলার মুদ্রা, সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের রাজা প্রথম আর্দশিরের মুদ্রা, উতপল সাম্রাজ্যের রাজা নন্দী গুপ্তের মুদ্রা, হাব্বারি সাম্রাজ্যের সুলতান ওমর বিন আবদুল আজিজের মুদ্রা ছাড়াও রয়েছে বাংলার সুলতান, দিল্লির সুলতান, জনপুরের সুলতান, আহমেদ নগর সুলতান ইত্যাদির মুদ্রা। আরো রয়েছে মোহাম্মদ বিন তুঘলকের শাসনামলের মুদ্রা, মুর্তজা নিজাম শাহের মুদ্রা, হোসাইন শাহর মুদ্রা, আলাউদ্দিন হোসেন শাহর মুদ্রা, নাসির আল দিন মাহমুদ শাহর মুদ্রা, টিপু সুলতানের মুদ্রা, চৌহান সাম্রাজ্যের রাজা পৃথ্বীরাজের মুদ্রা, রয়েছে দিল্লির সুলতান মোহাম্মদ ঘুরি এবং ইলতুতমিশের মুদ্রা, মুঘল সাম্রাজ্যের আকবর, শাহ জাহান, হুমায়ুন, আহমেদ শাহ, মোহাম্মদ শাহ, শাহ আলম, ফাররুখ শিয়ারের মুদ্রা, খিলজি সাম্রাজ্যের আলাউদ্দিন খিলজির মুদ্রা, দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের মুদ্রা, ব্রিটিশ শাসন আমলের রানি ভিক্টোরিয়া, সপ্তম এডওয়ার্ড, পঞ্চম ও ষষ্ঠ জর্জ আমলের মুদ্রা, কাশ্মীরের সুলতান ইসমাইল এবং প্রচীন বাংলার শাসক হুসাইন শাহের মুদ্রা, বাহামানী সুলতান ফাতেহ শাহ এবং আলাউদ্দীন আহমেদ শাহের মুদ্রা।

প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহের একপর্যায়ে তার পুরাতন অ্যান্টিক সামগ্রী সংগ্রহের প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে। তার এ এন্টিক সংগ্রহের পেছনে অনেক বড় ভূমিকা হচ্ছে তার নিজ এলাকায়। যখন থেকে জানতে পারে এলাকায় প্রাচীন সামগ্রীতে এত সমৃদ্ধ তখন থেকে এন্টিক সংগ্রহের প্রতি তার আগ্রহ অনেক গুণ বেড়ে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শরিফুল ইসলাম তার ‘ দ্য সুলতানাত পিরিয়ড অব বেঙ্গল’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর থানার রহনপুর উপজেলার নওদাবুরুজ অর্থাৎ যেখানে বখতিয়ার খিলজি, রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে প্রাচীন বাংলায় নিজের শাসন স্থাপন করেন সে স্থানের কথা। এ ছাড়াও এ এলাকায় অনেক প্রাচীন নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এসব জায়গা থেকে সে অনেক কিছু সংগ্রহ করে রেখেছে। বিলুপ্তপ্রায় অনেক সরঞ্জামাদি যেমন মাটির বাটখারা, পোড়ামাটির ফলক, ইটের টুকরা, পাথরের থালা, প্রাচীন মুদ্রা এবং তাদের কিছু কিছু ব্যবহার্য জিনিসের ধ্বংসাবশেষ। এসব সংগ্রহ করতে তার ক্রীড়াপ্রেমিক বাবা তাকে অনেক সাহায্য করেছেন। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া অনেক জিনিস আছে, যেগুলো বর্তমান যুগে এন্টিকের তালিকায়। যেমন পিতলের হাঁড়ি, বদনা, পিতলের গ্যাস স্টোভ, পিতলের বাটখারা, হুঁকা, পিতলের নকশা করা থালা, পুরাতন তালা-চাবি, শীল-পাটা, কয়লার ইস্ত্রি, পিতলের জগ, চেরাক, লণ্ঠন, ফুলদানি, কলের গান, কাঠের কারুকার্য খচিত বিভিন্ন বাক্স, পুরাতন ডাকটিকিট, দলিল-দস্তাবেজ, ক্যামেরা ও ব্যবহার্য সামগ্রী এবং ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন জমির দলিল ইত্যাদি তার ও পরিবারের কাছে রয়েছে। মাহির আরেকটি ব্যতিক্রমী শখ হচ্ছে, পাখির পালক সংগ্রহ করা।

মুদ্রা সংগ্রহ ও শখের বিষয়ে তার সহপাঠী কিরণ বলেন মাহির মুদ্রা, টাকা-পয়সা ও প্রতœতাত্ত্বিক ইতিহাস সংরক্ষণে খুবই আগ্রহী।

মাহির বাবা মোবারক হোসেন জানান, মাহিরকে আমরা উৎসাহ, উদ্দীপনা ও সহযোগিতায় করি। পড়ালেখার পাশাপাশি তার এ ধরনের শখের বিষয়টি খুব ভালো। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সাধারণ জনগণ তাকে সব সময় উৎসাহ দিয়ে আসছে।

মাহির ইয়াসির জানায়, নিজ উদ্যোগে ছোট বেলা থেকেই মুদ্রাসহ অন্যান্য উপাত্ত বস্তু সংগ্রহে মনোনীবেশ হয়। এগুলো সংগ্রহে অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে করতে হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ছাত্রাবস্থায় পুরাতন বা নতুন সামগ্রী অথবা কয়েন বা মুদ্রা সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তার এ সমস্ত সংগ্রহের পেছনে তার বাবার ভূমিকা রয়েছে। এসব মুদ্রা সংগ্রহ করার জন্য তাকে অনেক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close