নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৭ জানুয়ারি, ২০২১

বিষেই কাটবে সাপের বিষ

২০৩০ সালের মধ্যে সাপের কামড়ে মৃত্যু কমিয়ে আনার লক্ষ্য

প্রতিবছর সাপে কামড় দেয় এক লাখেরও বেশি মানুষকে। কার্যকরী ওষুধের অভাবে মৃত্যু হয় ৬ হাজার জনের। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বিষধর সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। এই লক্ষ্যে তিন বছর আগে দেশে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে গড়ে তোলা হয় একটি অ্যান্টিভেনম রিসার্চ সেন্টার। পদ্ম গোখরা, খৈয়া গোখরা, কাল কেউটে, শঙ্খিনী, দুই প্রজাতির সবুজ বোরা লালন পালন হচ্ছে গবেষণাগারে। এগুলোর বিষ থেকেই তৈরি হবে প্রতিষেধক।

গবেষকরা বলছেন, এর বাইরেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অবৈধ সাপের খামার গড়ে উঠেছে পটুয়াখালী, ফেনী, গাজীপুর, সাভার, রাজশাহী, পাবনা, ফরিদপুরে। এরপরও প্রতি বছর ভারত থেকে সাপের অ্যান্টিভেনাম আমদানি করা হয়, যা চাহিদার তুলনায় খুবই কম।

তবে ওষুধ গবেষকরা বলছেন, বিষ থেকে সাপে কাটার প্রতিষেধক দেশে তৈরি করলে খরচ বেশি হবে। তাই আমদানি করেই চাহিদা মেটানো সম্ভব। গবেষকরা আরো বলছেন, সাপের বিষ আমদানি-রপ্তানি নিষিদ্ধ। এরপরও সম্প্রতি রাজধানীতে ৩১ পাউন্ড সাপের বিষ জব্দ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে খামার থেকে বিষ পাচার হচ্ছে কিনা সেদিকে নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ তাদের। অস্ট্রেলিয়ান ভেনাম রিসার্চ ইউনিটের প্রধান মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ডেভিড উইলিয়ামের মতে, সাপে কাটে দরিদ্র এলাকার মানুষকে, গরিবেরাই মরে বেশি; ভাগ্যক্রমে কেউ বেঁচে গেলে তার অবস্থা আরো শোচনীয় হয়ে উঠে। তাতে নীতিনির্ধারক বা অন্যদের কী যায় আসে!

এদিকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে সাপের কামড়ে মৃত্যু অর্ধেকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে। এই লক্ষ্যে গঠিত কোর ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ড. উইলিয়াম। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের একটা সমন্বিত, সাশ্রয়ী এবং টেকসই ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে হবে, না হলে আমরা প্রজেক্টের মধ্যেই ঘুরপাক খাব আর মানুষ মরতেই থাকবে।’

বাংলাদেশে এখন মাতৃমৃত্যু অপেক্ষা সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার বেশি। দেশে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষকে সাপে কামড় দেয়। এর মধ্যে প্রতিদিন ১৬ থেকে ২০ জন মানুষ মারা যায়, বছর শেষে সেই হিসাব ৬ থেকে ৭ হাজারে গিয়ে ঠেকে। এটা আনুমানিক হিসাব। সব শবের গণনা হয় না। জন্মনিবন্ধন হলেও সম্প্রতি ভাগাভাগির বিষয় না থাকলে মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

সূত্র জানায়, ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে দেশে প্রথমবারের মতো অ্যান্টিভেনাম তৈরির লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আর্থিক সহায়তায় পাঁচ বছর মেয়াদি অ্যান্টিভেনাম তৈরির প্রকল্পটিতে যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা। জার্মানি থেকে জীববিজ্ঞানীরা এসে নিজেকে নিরাপদ রেখে বিষধর সাপ ধরা ও সাপগুলোকে খাইয়ে সুস্থ অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু এই প্রকল্প শেষ হবে ২০২২ সালে। সে হিসাবে বলা যায়, অ্যান্টিভেনাম তৈরির কাজটি এখন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে আমরা করোনাকালে বন্দি হয়ে গেছি। সবকিছুর সঙ্গে গবেষণাও বিঘিœত হচ্ছে, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যু বন্ধ নেই।

এক গবেষণায় জানা যায়, সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে চিকিৎসকের কাছে যায় মাত্র ৩ শতাংশ ব্যক্তি। যারা যান বা যাদের নিয়ে যাওয়া হয়, তারা একান্ত বাধ্য হয়ে যান। তার আগে স্থানীয়ভাবে নানা চেষ্টা তারা করেন। বেশির ভাগ সময়ই স্থানীয় চেষ্টা সফল হয়, কারণ দেশের ৮২ থেকে ১০০ প্রজাতির সাপের মধ্যে মাত্র ছয় ধরনের সাপ বিষধর। বাকিগুলো কামড়ালে কিছু হয় না। কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ওই রোগীরা সুস্থ হয়ে যান। কথিত ওঝারা সেই সুযোগটা কাজে লাগান। আবার মাঠপর্যায়ে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, তাদেরও সাপেকাটা রোগীর প্রাথমিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এখনো সাপে কামড়ালে সাবেকি পদ্ধতিতে আক্রান্ত ব্যক্তির হাত বা পা এমন শক্ত করে বাঁধা হয় যে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এতে কারো কারো গ্যাংগ্রিনও হয়ে যায়। এত শক্ত করে বাঁধার কোনো প্রয়োজন নেই। আক্রান্ত হাত বা পা যেন নড়াচড়া করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখলেই হবে। সে ক্ষেত্রে সতর্কতা হিসেবে হাত বা পায়ের দুই পাশে কাঠের টুকরা দিয়ে কাপড় দিয়ে আলতো করে বেঁধে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। তা ছাড়া পল্লী এলাকার বাস্তবতা এবং সাপের ধরন সম্পর্কে জ্ঞান হালনাগাদ করার জন্য মাঠপর্যায়ে নিয়মিত আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close