তাজুল ইসলাম, মুক্তাগাছা (ময়মনসিংহ)
কেঁচো সারে স্বাবলম্বী নারী
মুক্তাগাছার দুল্লা ইউনিয়নের পল্লীতে জৈব পদ্ধতিতে কেঁচো সার তৈরি ও ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন দরিদ্র গৃহিণী মোজেদা খাতুন। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজ বাড়ির আঙিনায় কেঁচো সার উৎপাদন করে একদিকে হয়েছেন স্বাবলম্বী অন্যদিকে তার স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন জয়িতা পুরষ্কার। দরিদ্র বাবার বাড়িতে লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি মোজেদা বেগমের। অল্প বয়সে বিয়ের পর স্বামী আলতাব আলী দুদুর ঘরে এসেও দারিদ্রতা তার পিছু ছাড়েনি। স্বামী-স্ত্রী সন্তানাদি মিলে পাঁচ সদস্যের পরিবার। পরের বাড়িতে কাজ করেও পেট ভরে দুই বেলা খাবার জুটেনি তাদের। তবে আত্মবিশ্বাসী মোজেদা দমে যাননি। কিছু একটা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তাগিদ ছিল তার। ৯ বছর আগে স্থানীয় একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান গ্রাউসের সহযোগিতায় উপসহকারী কৃষি অফিসার মো. সেলিম রেজার কাছ থেকে কেঁচো সার (ভার্মি কম্পোস্ট) তৈরির পদ্ধতি প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে এনজিও প্রতিষ্ঠানটি প্রত্যেককে কেঁচো সার উৎপাদনের জন্য এক কেজি কেঁচো ও তিনটি চারি (মাটির এক প্রকার পাত্র) দেয়। এই কেঁচো দিয়েই শুরু করেন কেঁচো সার উৎপাদনের কাজ। এই কেঁচো সারই স্বাবলম্বী হওয়ার রাস্তা দেখিয়েছে তাকে। ছেলে-মেয়ের লেখা-পড়ার পাশাপাশি সংসারের বাজার খরচেও রয়েছে তার অবদান। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার দুল্লা ইউনিয়নের দুল্লা ইউনিয়নের পশ্চিম চন্ডিমণ্ডপ গ্রামে বসবাস মোজেদার। অর্থনৈতিকভাবে সফলতা অর্জনকারী নারী হিসেবে মোজেদা ২০১৮ সালে জয়িতা পুরস্কার অর্জন করেন। মোজেদার রয়েছে ফজিলা, আনোয়ারা ও মরিয়মসহ ৩০ জনের একটি দল। এখান থেকে প্রতি মাসে তাদের তিন থেকে চার টন কেঁচো সার উৎপাদিত হয়। এলাকার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিশেষ করে দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নেত্রকোনা, সিলেটে বিক্রি করা হচ্ছে কেঁচো-সার। এই কেঁচো-সারের বেশির ভাগই কিনে নিচ্ছেন ফলমূল ও সবজি উৎপাদনকারী বিভিন্ন খামারিরা। প্রতি কেজি কেঁচো সার ১০ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি করা হয়। এ ছাড়াও এই ইউনিয়নের বিভিন্ন ওয়ার্ডের প্রায় ২ শতাধিক দরিদ্র পরিবারের গৃহিণী সংসারের কাজের পাশাপাশি নিয়মিত উৎপাদন করে যাচ্ছেন কেঁচো-সার।
উপজেলা কৃষি বিভাগের উপসহকারী কৃষি অফিসার (পেস্ট ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও শস্য হাসপাতালের ডাক্তার) মো. সেলিম রেজা বলেন, কেঁচো-সার (ভার্মি কম্পোস্ট) ফসলের অবশিষ্টাংশ, গবাদিপশু ও গৃহপালিত পশুপাখির মলমূত্র, শাকসবজির অবশিষ্টাংশ, ডিমের খোসা, কচুরিপানা, বিভিন্ন প্রকার আগাছা, মাছের আইশ, পাকা কলার খোসা ইত্যাদি আংশিক পচিয়ে কেঁচো দিয়ে খাইয়ে যে সার পাওয়া যায় তাই কেঁচো-সার। ২৪ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপ মাত্রায় উৎপাদন খুব ভালো হয়। স্বাবলম্বী সেলিম রেজা বলেন মোজেদার লেখাপড়া না থাকলেও তিনি আত্মপ্রত্যয়ী, কঠোর পরিশ্রমী ও উত্তম সংগঠক। ৯ বছর আগে কেঁচো-সার সর্বপ্রথম মোজেদাসহ চারজনকে প্রশিক্ষণ দেই। এখন তার দেখাদেখি অত্র ইউনিয়নে প্রায় দুই শতাধিক দরিদ্র পরিবার এখন কেঁচো-সার চাষে স্বাবলম্বী।
উল্লেখ্য, মানুষের রোগ ব্যাধি দিন দিন বেড়েই চলছে। এর অন্যতম কারণ হলো দৈনন্দিন জীবনে যে সকল খাবার আমারা খাচ্ছি তা উৎপাদনে অধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সকল খাবার খাওয়ার ফলে রাসায়নিকের এক অংশ ঢুকছে আমাদের শরীরে। যে কারণে আমাদের শরীরে বাসা বাধছে ক্যানসারসহ নানা ধরনের মরণব্যাধি রোগ। অন্যাদিকে বাংলাদেশে অধিক জনসংখ্যার চাপে প্রতিদিন কমছে আবাদি জমি। উৎপাদন বাড়াতে ফসলি জমিতে রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ব্যবহারের ফলে জমির স্বাস্থ্য ক্রমান্বয়ে নষ্ট হচ্ছে। রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে ফসলি জমিতে শতকরা পাঁচ ভাগ জৈব পদার্থ থাকার কথা থাকলেও রয়েছে এক ভাগ। অধিক রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে জমিতে পুষ্টি উপাদান কমতির পাশাপাশি বিলীন হয়ে যাচ্ছে উপকারী পোকামাকড়ের অস্তিত্ব। এ থেকে বাঁচার উপায় জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ। জৈব পদ্ধতিতে কেঁচো-সার তৈরি ও ব্যবহার বাড়ানো গেলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত নিরাপদ স্বাস্থ্যসম্মত কৃষিপণ্য উৎপাদন করা সম্ভব। তাতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি চাষের খরচও কমে আসবে। এ সার দ্বারা উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলমূল শতভাগ নিরাপদ।
"