নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০

করোনা সংক্রমণ কোন স্তরে?

মার্চের শুরুতে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এই সময়ের মধ্যে সংক্রমণের চূড়া স্পর্শ নিয়ে অনেক তর্ক হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় অক্টোবরের শেষে ও নভেম্বরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা করছে সরকার। গত সোমবার মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠকে তাই বিদ্যমান অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রস্তুতির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর দৈনিক শনাক্ত রোগীর যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে তাতে সংক্রমণ কমে আসার একটি ধারণা তৈরি হতে পারে। তবে দৈনিক পরীক্ষার সংখ্যা কমে আসায় ওই পরিসংখ্যান প্রকৃত চিত্র দিচ্ছে কিনা সেই সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। নয়তো ‘দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ চক্রে’ পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তাহলে এখন মহামারি কোন পর্যায়ে আছে? পরীক্ষা বাড়িয়ে সঠিক চিত্র তুলে আনার ব্যবস্থা না হলে দেশ ‘দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ চক্রে’ পড়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা ডা. বেনজির আহমেদ। অধিদফতরের দেওয়া পরিসংখ্যান তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন যে প্রতিবেদনটা দিচ্ছে, সেখানে সংক্রমণের মাত্রাটা কমছে। কিন্তু মহামারির প্রকৃত চিত্রটা আমরা পাচ্ছি না। কোথায় সংক্রমণ বাড়ছে, কোথায় কমছে- আমরা জানি না। আমরা অ্যান্টিবডি টেস্ট করছি না। অ্যান্টিবডি টেস্ট দিলে বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণের অবস্থাটা দেখতে পাব।’

শুরু থেকে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে করোনা শনাক্তের কাজ চলছে। এই পরীক্ষা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ তবে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত। অন্যদিকে উপসর্গহীন (অ্যাসিম্পটোম্যাটিক) করোনা আক্রান্তের পরও সেরে উঠেছেন, তাদের অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করা সম্ভব। তা করা গেলে করোনা আসলে কতটা ছড়িয়েছে জানা যাবে বলে মনে করেন এই গবেষক।

তবে সরকার সম্প্রতি অ্যান্টিজেন পরীক্ষার জন্য র‌্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহারের অনুমতি দিলেও অ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন দেয়নি। মহামারি হলে এটা করতে হয় উল্লেখ করে বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘কিন্তু আমাদের এখানে যারা টেস্ট করাতে চাচ্ছে, শুধু তাদেরই করা হচ্ছে। ৩০ শতাংশ লোক যদি উপসর্গহীন হয় এবং তাদের ট্রেসিং না করি; তাহলে যে সংখ্যাটা আমরা পাচ্ছি, সেটা কিন্তু প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তুলছে না।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, মধ্য জুন থেকে জুলাইয়ের শুরু পর্যন্ত দেশে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজারের মধ্যে। সেপ্টেম্বরে তা কমে আসে প্রতিদিন দেড় থেকে ২ হাজারের মধ্যে। এই সময়ে দেশে আরটি-পিসিআর ল্যাব বাড়লেও পরীক্ষার সংখ্যা কমেছে। জুনের শেষ আর জুলাইয়ের শুরুতে দৈনিক ১৭ থেকে ১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা হলেও এখন তা ১১ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে।

সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতর দিয়েছে তাতে দেশে করোনায় আরো ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৫ হাজার ৭২ জনে। এ ছাড়া নতুন করে শনাক্ত হয়েছে আরো ১ হাজার ৫৪০ জনের দেহে। এ নিয়ে দেশে শনাক্ত হলো ৩ লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৪ জন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেষ্টা বে-নজির বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধিটা হল জনগণের বিষয়, আর সরকারের বিষয় হলো ট্রেসিং, টেস্টিং, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন। এগুলো ঠিকমতো করলে স্বাস্থ্যবিধিতে বিচ্যুতি ঘটলেও সংক্রমণের আশঙ্কা কমে যাবে।’ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও ‘ভুল অ্যাপ্রোচের’ কারণে ভাইরাসের বিস্তার ‘আসলে কমানো যাচ্ছে না’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে ইউরোপ-আমেরিকার মতো বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে সংক্রমণের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সেজন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে একই ধরনের আশঙ্কার কথা বলেছে। এ বিষয়ে ডা. বে-নজির বলেন, ‘দেশে ফার্স্ট ওয়েভই এখনো শেষ হয়নি। ইউরোপের অনেক দেশ বা চীন তো দৈনিক শনাক্ত রোগী শূন্যতে নামিয়ে আনল। আমরা ৬ মাসেও এটা পারলাম না। আমরা এটাকে বলছি, ওয়েভ ইমপোজড। অর্থাৎ যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে যে ঢেউটা আছে, সেটার ওপর আরেকটা ঢেউ পড়বে। মানে আমরা নিচে নামব না।’

মহামারি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া না হলে দ্বিতীয় দফায় দীর্ঘ সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন করোনা সঙ্কটে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘যারা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়েছে, তারা স্থানীয় সরকারকে কাজে লাগিয়েই তা করেছে। তারা ঘরে ঘরে গিয়ে কাজ করেছে। চীন নিয়ন্ত্রণ করতে পারল কমিউন সিস্টেমের মাধ্যমে, আমাদের জেলা পর্যায়েও সে ক্ষমতা নাই।’

সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রকাশিত তথ্যানুসারে, ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন আরো ২ হাজার ১৩৯ জন। এ নিয়ে সুস্থ হলেন ২ লাখ ৬৫ হাজার ৯২ জন। দেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ৮ মার্চ তা সাড়ে ৩ লাখ পেরিয়ে যায় ২১ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে ২ জুলাই ৪ হাজার ১৯ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় যা এক দিনের সর্বোচ্চ শনাক্ত। প্রথম রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। ২২ সেপ্টেম্বর সেই সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

পরিসংখ্যান সম্পর্কে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক বলেন, ‘এখনো প্রবাহটা পুরোপুরি বোঝা যাচ্ছে না। যদি সংক্রমণের হার ২ থেকে ৩ সপ্তাহ ধরে কমতে থাকে তাহলে একটা ট্রেন্ড বোঝা যাবে। জুন, জুলাই, আগস্টে ২০ শতাংশের ওপরে ছিল দৈনিক শনাক্তের হার। মৃত্যুর সংখ্যার চেয়ে শনাক্তের হার দিয়ে আমাদের সংক্রমণের অবস্থাটা কোন পর্যায়ে সে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। এটার সঙ্গে অন্য দেশের তুলনা করলে হবে না। কারণ ভারতে শনাক্তের হার ৮-৯ শতাংশ কিন্তু সেখানে করোনাভাইরাস এখন উঠতির দিকে।’

মহামারির এই পর্যায়ে বাংলাদেশের করণী সম্পর্কে মুশতাক হোসেনের পরামর্শ ‘প্রথমত সরকারের পক্ষ থেকে আক্রান্তদের আইসোলেশন সেন্টারে নেওয়া ও তাদের সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টাইন করা। এজন্য আর্থসামাজিক সহায়তা দরকার হবে, না হলে মানুষ উৎসাহিত হবে না। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য তৃণমূল পর্যায়েও সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সহায়তা দিতে হবে সরকারকে।’

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ১৩ হাজার টেস্ট করে ১২ শতাংশ সংক্রমণ পাই তাহলে ৫০ হাজার টেস্ট করালে ৫ শতাংশের নিচে চলে আসবে। বাস্তবতা হলো, আমাদের সংক্রমণ কমে এসেছে।’ তবে মহামারি ‘কমে আসছে’ বলার মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি বলেই মনে করেন আলমগীর। তিনি বলেন, ‘এখন যেটা কমছে, যদি আরো সপ্তাহ দু-এক কমার প্রবণতা থাকে তাহলে হয়ত একটা সহনীয় পর্যায়ে আসবে। কিন্তু মহামারি থাকবেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে হলে সেটাকে ‘টলারেবল রিলিফ’ বলা হবে। সেটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।’

সরকার পরীক্ষার সংখ্যা আরো বাড়ানোর চেষ্টা করছে বলে জানান আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, আক্রান্তদের একটি অংশের উপসর্গ থাকে না। যুক্তির খাতিরে যদি ধরাও হয় যে দেশের ১০ বা ১২ শতাংশ মানুষ এ পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছে তারপরও ৯০ শতাংশ মানুষ সংক্রমণের বাইরে রয়েছে। ফলে যেকোনো সময় যে কেউ সংক্রমিত হতে পারে যদি সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলে।

দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাপের শঙ্কা কতটা সেই প্রশ্নে এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘সেকেন্ড ওয়েভ যে হবেই সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। এটা এড়াতে চাইলে প্রয়োজন সর্বোচ্চ সতর্কতা। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানি, তবে যেকোনো সময়ে সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। যেহেতু কোনো ভ্যাকসিন নেই, তাই সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে। মাস্ক পরা ও হাত ধোয়ার বিকল্প নেই।’

তবে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার বাইরে লকডাউনের মতো কড়াকড়ি আরোপের কথা আপাতত ভাবছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘যেহেতু হারটা এখন কমের দিকে, আর জীবিকা নিয়েই মানুষ বেশি চিন্তিত, সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে যে সচেতনতার বার্তা আছে, সেটা চলবে। কিন্তু আইনগতভাবে কড়াকড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা এখন নাই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close