নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

বিদ্যাপীঠ বন্ধ : স্টেশনারি ব্যবসায়ীর মাথায় হাত

মাঝেমধ্যে দুই একজন ক্রেতা আসছেন, আবার কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হচ্ছে

স্টেশনারি ব্যবসা, দেশে ব্যাপক চলমান একটি ব্যবসা। স্টেশনারি পণ্যের চাহিদা প্রায় সারা বছরই সমান থাকে। করোনাভাইরাসের কারণে ছয় মাস ধরে দেশের বিদ্যাপীঠগুলো বন্ধ থাকায় এই ব্যবসাটি এখন ধ্বংসের পথে। শুধু তাই নয়, স্টেশনারি পণ্যগুলোর উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। তারা পুঁজি ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। অভাব অনটনে এখন তাদের মাথায় হাত।

গত রোববার সরেজমিন নীলক্ষেত ও পুরান ঢাকার বাবু বাজারের সৈয়দ হাসান আলী লেনের পাইকারি প্রতিষ্ঠান এবং কারখানাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, খুব একটা হইচই নেই পাইকারি দোকানগুলোতে। মাঝে মধ্যে দুই-একজন ক্রেতা আসছেন আবার কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকছেন দোকান মালিক ও কর্মচারীরা। কারখানাগুলোও কমিয়েছে লোকবল। দোকান মালিকদের তথ্য মতে, এই স্টেশনারি ব্যবসায়ে পাইকারি দোকানগুলোতে দিনে এক থেকে দেড় লাখ টাকা বিক্রি হতো। আর খুচরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্রি হতো ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। কিন্তু করোনার কারণে এখন বিক্রি নেই। বর্তমানে অনেকেই চলছেন ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে। আবার অনেকে দোকান ভাড়াই দিতে পারছেন না। ফলে অনেকটাই হতাশা ব্যবসায়ীরা।

নীলক্ষেতের স্টেশনারি ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা খুব করুণ অবস্থায় আছি। বর্তমানে প্রতিদিন ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা বিক্রি হয়। নরমাল সময়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হতো প্রতিদিন। এই ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা বিক্রি করে আমাদের তেমন কিছুই হয় না। দোকান ভাড়া আছে, আমাদের থাকা-খাওয়ার খরচ আছে, বাসা ভাড়া আছে এমন একটা অবস্থা খাওয়ার পয়সাই উঠে না, ঘরভাড়া কোথা থেকে দেব। বর্তমানে আমরা ঋণগ্রস্ত।’

নীলক্ষেতে আরেক ব্যবসায়ী মমিনুর মিয়া বলেন, ‘ছয় মাস ধরে ব্যবসা একেবারেই শেষ। এখন যে দোকানের মালামাল দেখছেন, এগুলো নতুন করে ঋণ নিয়ে কেনা। পুরো মার্কেটের বাকি ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা এখন। স্কুল-কলেজ না খুললে আমাদের ব্যবসা হয় না, স্কুল-কলেজের সঙ্গেই আমাদের ব্যবসা। এখন সেই অপেক্ষাতেই আছি।’ স্টেশনারি ব্যবসার পাইকারি ব্যবসায়ীরা বসে আছেন গোমরা মুখে। করোনার সাধারণ ছুটিতে দুই মাস একেবারেই বন্ধ ছিল পাইকারি ব্যবসায়ের মার্কেট। পরবর্তী সময়ে সরকার সব অফিস আদালত খুলে দেয় সীমিত পরিসরে। তখন থেকে শুরু হয় আবারো স্টেশনারি ব্যবসা। তবে স্টেশনারি ব্যবসা জড়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ফলে ব্যবসা শুরু হলেও শুধুমাত্র ব্যবসা ধরে রাখার জন্য মাসের পর মাস পরিচালনা খরচ বহন করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।

পুরান ঢাকার বাবু বাজারের সৈয়দ হাসান আলী লেনের পাইকারি আবদুর রহমান বলেন, ‘করোনা পরবর্তী সময়টায় আমাদের খুব খারাপ অবস্থা হয়েছে। ব্যবসা ছিল এককেন্দ্রিক। শুধু অফিস-আদালতে মালামাল সাপ্লাই করি এখনো। অন্যদিকে স্কুল-কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে ব্যাপক মালামাল লাগত সারা বছর, সেই অংশটা এখনো বন্ধ আছে। করোনার আগে আমাদের প্রতিদিন ৮০ থেকে এক লাখ টাকা বিক্রি ছিল। এখন আমাদের বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এদিকে বিদেশি মালামালের জন্য ঋণের চাপ আছে। আমাদের এখন একটাই চাওয়া, সরকারের কাছে স্কুল-কলেজ খুলে দিলে হয়তো আমাদের ব্যবসা আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।’

আরেক ব্যবসায়ী ইকরাম হোসেন বলেন, আগে যখন সবকিছু খোলা ছিল তখন অনেক ভালো ব্যবসা হতো। এখন স্কুল বন্ধ, তবে অফিস-আদালত খোলা থাকার কারণে টুকটাক বিক্রি হচ্ছে। এতে করে দোকান ভাড়াটা অন্তত দিতে পারছি। আগেই স্কুলের জন্য খাতা, ডায়েরি, ফাইলসহ অনেক কিছু অর্ডার হতো। এখন এগুলো বিক্রি বন্ধ, সেইসঙ্গে কাজও বন্ধ আছে। আগে ডেইলি এক থেকে দেড় লাখ টাকা বিক্রি হতো, এখন হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। বর্তমান অবস্থায় ব্যবসায় কোনো লাভ হচ্ছে না।

উৎপাদনকারী ইউসুফ আহমেদ বলেন, এই এলাকায় সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক কর্মী স্টেশনারি পণ্য উৎপাদনে কাজ করেন। কিন্তু সেই কর্মী সংখ্যা এখন প্রায় ৬০ হাজার। বাকিদের বাধ্য হয়ে কাজ থেকে অব্যাহতি দিতে হয়েছে। কারণ নিয়মিত ইনকাম ছাড়া তাদের বেতন দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।

তার দেওয়া তথ্যের সত্যতা মিলেছে স্টেশনারি উৎপাদনকারী কারখানাগুলো ঘুরে। স্টেশনারি পণ্যের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকা কর্মীর সংখ্যা কমেছে। মাসের পর মাস বেতন দিতে না পারায় মালিকরা আর কর্মীদের ধরে রাখতে পারেননি। বাধ্য হয়ে অনেক কর্মীকেই অব্যাহতি দিতে হয়েছে কাজ থাকে। প্রতিটি ১০ জন কর্মীর কারখানায় লোকবল কমেছে বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ।

ফাইলবক্স তৈরি কারখানার মালিক উজ্জ্বল সরকার বলেন, ‘বাবা কী করব, এখন তো সবাইকে বেতন দিতে পারি না। অর্ডার কম। দীর্ঘদিন ধরে আমার এই কারখানাটিতে ১০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। করোনায় দুই মাস বন্ধ ছিল। এখন অর্ডার নেই বললেই চলে। মাত্র তিনজন নিয়ে কারখানা চালাই। তারপরও অপেক্ষা করতে হয় আরেক অর্ডারের জন্য। আর আগে ১০ জনেও কাজ শেষ করতে পারতাম না।

স্টেশনারি ব্যবসায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অপেক্ষায়। তাদের আশা স্কুল-কলেজ খুললেই ব্যবসা আবার ঘুরে দাঁড়াবে। মেশিনের শব্দে কারখানা হবে মুখর, আর পাইকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আবার জমজমাট হয়ে উঠবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close