এস এইচ এম তরিকুল, রাজশাহী ব্যুরো

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আরএমপি কর্মকর্তার সম্পদের পাহাড়!

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) ‘বড় ভাই’ নামে খ্যাত প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিফের অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহীল কাফি স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তবে আগের মতো এবারও অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন এই কর্মকর্তা। সূত্র জানায়, প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিফ আরএমপিতে যোগ দেওয়ার পর বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি বাণিজ্য, পদোন্নতি, থানা থেকে মাসোহারা তোলা, নিয়োগ, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেওয়া, মালামাল না কিনেই বিল উত্তোলন এবং ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে নিজেও কৌশলে ঠিকাদারির কাজ করে এ সম্পদ অর্জন করেছেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৭ সালে আবদুল লতিফ প্রধান সহকারী হিসেবে আরএমপিতে আসেন। এ পর্যন্ত তিনি চতুর্থ শ্রেণির ১৪ জন কর্মচারী নিয়োগ করেছেন। যাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে নিয়েছেন সাত থেকে আট লাখ টাকা। এ ছাড়া আরএমপির ১২টি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) অন্যদের বদলি ও পদায়নের ‘গুরুদায়িত্ব’ পালন করেন তিনি। এ কারণে থানার ওসিরা তাকে ‘বড় ভাই’ বলে সম্বোধন করেন। আরএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে প্রতিটি থানা থেকে মাসোহারা নেন লতিফ।

সূত্র মতে, ২০১৭ সালে আবদুল লতিফ একদিনেই ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের নিজ নামীয় হিসাব থেকে ৪০ লাখ টাকা এবং তার গৃহিণী স্ত্রীর হিসাব থেকে ৫৮ লাখ টাকা তোলার জন্য চিঠি দেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি জানতে পারলে একজন কর্মচারীর এত টাকার বিষয়ে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দেয়। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে সবকিছু ম্যানেজ করেন লতিফ।

আরএমপির এই কর্মচারীর মহানগরীর আলীগঞ্জ মৌজায় প্রায় ২ কোটি টাকার ১০ কাঠা জমি, কাজিহাটা মৌজায় ২৫০ কোটি টাকার চার কাঠা জমি, নাটোর শহরে ২৫০ কোটি টাকা মূল্যের ১০ কাঠা জমি, নাটোরের বাগাতিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে ২ কোটি টাকার ৪০ বিঘা জমি এবং ঢাকায় ২ কোটি টাকার দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া নামে-বেনামে রাজশাহী শহরে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি।

অভিযোগ মতে, দরপত্র আহ্বান করলেও সব ঠিকাদারকে শিডিউল না দেওয়া আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিফের একটি অভ্যাস। তিনি ২০১৫ সাল থেকে বেশির ভাগ মেরামত ও সংস্কারকাজ, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা থেকে শুরু করে আরো অনেক কাজ চারঘাটের সারদার আবদুর রহমান মুন্না নামে এক ঠিকাদারের মাধ্যমে করছেন। এই ঠিকাদারের পরিবারের সদস্যদের নামে ১০-১২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১৮-১৯ সালে পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি জালিয়াতি করে এই ঠিকাদারকে তিনি কাজ দিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হলে লতিফের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। কিন্তু তিনি এখনো আরএমপিতে বহাল।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত আরএমপিতে মেরামত ও সংস্কারকাজ হয়েছে ৬ কোটি ৭০ লাখ টাকার। যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা হয়েছে ১১ কোটি টাকার। এসব মেরামতে ব্যয় করা হয়েছে ৫৭ লাখ টাকা। ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামে ব্যয় হয়েছে ১৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা।

অভিযোগ রয়েছে, মেরামত ও সংস্কারকাজের মাত্র ৩০ ভাগ কাজ করে বাকিটা লুটপাট করেছেন লতিফ ও তার মনোনীত ঠিকাদার। যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা হয়েছে বাজারদরের চেয়ে অধিক মূল্যে। আর্চওয়ে গেটের বাজার মূল্য ৭০ হাজার টাকা থাকলেও শিডিউল মূল্য ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। সাড়ে তিন হাজার টাকার সিসি ক্যামেরার শিডিউল মূল্য ছিল ১২ হাজার টাকা। এ ছাড়া ৫০-৫২ হাজার টাকা দামের কম্পিউটার কেনা হয়েছে ৯৮ হাজার টাকায়।

সূত্র আরো জানায়, প্রিন্টারের কালির শিডিউল মূল্য ছয় হাজার টাকা। লতিফ প্রতি মাসে ৫০টি কালির বিল করেন তিন লাখ টাকা। অথচ নতুন কালি না কিনে রিফিল করেন ৫০০ টাকায়। অর্থাৎ কালির নামেই প্রতি মাসে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন আরএমপির এই ‘বড় ভাই’। প্রতি মাসে অন্য স্টেশনারি সামগ্রীর বিল করেন চার-পাঁচ লাখ টাকা। আর মালামাল কেনা হয় বড়জোর ৭০-৮০ হাজার টাকার। এগুলো পত্রবাহক আজিজুল ইসলামকে দিয়ে কেনান। এজন্য প্রতি মাসে তাকেও ১৫ হাজার টাকা দেন লতিফ।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১৯-২০ সালে টাঙ্গাইলের ঠিকাদার মো. শাহিনের সঙ্গে পার্টনারশিপে ব্যবসা করেন লতিফ। ২০১৫ সালে ৭০ লাখ টাকার ওষুধ না কিনে টাকা আত্মসাতের ঘটনা জানাজানি হলে পুলিশ সদর দফতর হাসপাতালের তৎকালীন সুপারিনটেনডেন্টকে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে বদলি করা হয়। আর আরএমপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিফকে টেন্ডার এবং কেনাকাটা কার্যক্রম থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু আরএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে লতিফ আছেন একই দায়িত্বে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে লতিফের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই আগেই চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু চিঠি পড়ে লতিফের হাতেই। যে কারণে তিনি বিষয়টি গোপন রাখেন। সম্প্রতি আরেকটি টেন্ডারে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে গত ৯ আগস্ট একটি নির্দেশনা জারি করে পুলিশ সদর দফতর। এতে বিভাগীয় মামলা অথবা বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য বলা হয়। বিষয়টি তদন্তের জন্য পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার আবদুস সালামকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি তদন্ত করছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে আবদুল লতিফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। পরে আরএমপির মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস গত শনিবার সন্ধ্যায় প্রতিদিনের সংবাদের এই প্রতিবেদককে এ বিষয়ে বলেন, ‘আবদুল লতিফের অর্জিত সম্পদের ঘটনায় তদন্ত চলছে। এই তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের একজন পুলিশ সুপার। যে কারণে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।’

আগের মতো এবারও প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবদুল লতিফের তুঘলকি কর্মকা- ধামাচাপা পড়বে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়েও জানি না। তবে আগে এমন ঘটনা ঘটে থাকলেও এবার আরএমপি বিষয়ে এমন অভিযোগ তোলার সুযোগ নেই। কারণ, এবার তদন্ত কার্যক্রম আরএমপি করছে না।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close