রেজাউল করিম শামিম
দূরে কোথাও
স্মৃতিময় আগরতলার কিছু টুকরো স্মৃতি
কুমিল্লার নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। আর তার রাজধানী আগরতলা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ন স্মৃতি জড়িয়ে আছে আগরতলাকে ঘিরে। আমার বাড়ি কুমিল্লা শহরে। ফলে সহজেই বিবিরবাজার ইমিগ্রেশন পার হওয়া যায়। আগরতলা যাওয়া-আসা করাও সহজ। আগরতলার সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আবহাওয়া, ভাষা, আচার-আচরণের নৈকট্যও বেশি। এমনকি গোমতীও আমাদের দুই শহরের অভিন্ন নদী। প্রতিবেশীর বাড়িতে যাওয়ার মতো করেই অনেকবার গেছি আগরতলা। ফলে সেখানকার লোকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, তাদের ঘিরে কাটানো স্মৃতিও অনেক। সর্ব শেষবার আগরতলা ঘুরে আসা হলো। একান্ত নিজস্ব স্মৃতিময়তায় ঘেরা সময়ের কিছুটা শেয়ার করছি।
(গত সংখ্যার পর)
ভ্যানগার্ড এবং বাংলা বলয়
আগরতলার অত্যন্ত পুরোনো এবং জনপ্রিয় নিউজ চ্যানেল ‘ভ্যানগার্ড’ কার্যালয় গিয়েছিলাম শুক্রবার। সুমন আমন্ত্রণ জানিয়োছিল। সুমনের পুরো নাম কাজী মাহতাব সুমন। সে কুমিল্লায় আমার ঘনিষ্ঠজনদের অন্যতম। তার সুকন্ঠের আবৃত্তিতো বটেই, যোগব্যায়ামের সংগঠক ও প্রশিক্ষক হিসাবে তার সুনাম-খ্যাতি জাতীয় পর্যায়ের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বলা চলে। সুমন, বাংলা সংস্কৃতি বলয়-এর আন্তর্জাতিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
সেই সুমনের সঙ্গে শুক্রবার দেখা আগরতলায়। আমি আর সানাই তখন ’বিশাল বাজার’ নামে একটি শপিংমলে ব্যাস্ত কেনাকাটায়। হঠাৎ সুমনের ফোন। সে জানালো তার সংগঠনের সভাপতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। আরএমএস চৌমুহনীতেই ভ্যানগার্ডের অফিস। সেখানে গিয়ে দেখা হলো, পরিচয় হলো দেবাশিস ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি সেবক ভট্টাচার্য নামেও পরিচিত। সুপরিচিত ভ্যানগার্ডের সম্পাদক। উনার সঙ্গেহ এর আগে দেখা হয়েছিল কুমিল্লা টাউন হলে ‘বাংলা সংস্কৃতি বলয়’-এর অনুষ্ঠানে। সুমন জানালো, তিনি এসংগঠনের আন্তর্জাতিক কমিটির সভাপতি। উনার সঙ্গে কথা বলে অনেক ভালো লাগলো। কথায় কথায় জানলাম এবারের পূজায় তাদের এলাকার ব্লাড মাউথ ক্লাবের উদ্যোগে পূজামন্ডপ গড়ে তোলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ থিমের উপর ভিত্তিকরে। এটা গোটা রাজ্যে বেশ আলোচিত এবং প্রশংসিত হয়েছিল। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের অনেকের সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল তাদের। প্রসঙ্গ সেবক ভট্টাচার্য ব্লাড মাউথ ক্লাবেরও সভাপতি।
অন্যদিকে সেবকদা ও সুমন জানালো, তাদের সংগঠনের ত্রিপুরার সংসদের উদ্যোগে প্রতি সপ্তাহের রবিবার শহর থেকে দূরে সেনপাড়ায় সাংস্কৃতিক হাট বসে। ৪৮ সপ্তাহ ধরে লাগাতার ভাবেই বসছে হাট। সেখানে লোকায়িত বাংলার বিভিন্ন পরিবেশনার মধ্যদিয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা, বিনোদনের ব্যবস্থা। এর পাশাপাশি বেচাকেনার মধ্য দিয়ে উপার্জন, কর্মসংস্থানের অনবদ্য একটি আয়োজন। সুমন বললো, বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির নবপর্যায়ে নবজাগরণের আতুর ঘর হিসাবেই চিহিৃত হবে এমেলা। সেবকদা আমন্ত্রণ জানালেন। বললেন, একদিন পরইতো রবিবার। দেখে যান। তিনি থাকার ব্যবস্থা করার কথাও জানালেন। কিন্তু আমার শতইচ্ছা থাকা সত্বেও থাকার সুযোগ ছিল না। এছাড়া জুম্মার নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় জমানো আড্ডা ছেড়ে বিদায় নিতে কষ্ট হচ্ছিল। বর্ষপূর্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিতে হলো।
জুম্মার নামাজ আদায়
বাইরে যেখানেই যাইনা কেন, জুম্মার জামাত যাতে বাদ না পরে যায় সেদিকে নজর থাকে। সেজন্যে আগে থেকেই জামে মসজিদ খুঁজে রাখি। এবার আগরতলা গিয়ে যে মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করেছি, তার নাম ’আগরতলা টাউন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ’। এর আগেও এ মসজিদে জুম্মা পড়েছি। সম্ভবত তখন এ মসজিদটির নাম ছিল অন্যকিছু। এবার মসজিদটিকে সংস্কার করে অনেক বেশি সুন্দর করে গড়ে তোলা হয়েছে। নামাজির সংখ্যাও আগের চাইতে অনেক বেশি। আগে গিয়েও নিচতলায় জায়গা না পেয়ে দোতলাতেই জামাতে অংশ নিতে হলো। খুব ভালো লাগলো।
ইমিগ্রেশনের বিড়ম্বনা
অনেকদিন আগরতলা যাওয়া হয়নি। ভিসাও ছিল। তাই ঘনিষ্ঠজন সানাইসহ সেদিন হঠাৎই বিবির বজার চেকপোষ্ট দিয়েই আগরতলা গিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কুমিল্লার ইমিগ্রেশনের বিড়ম্বনা মনে থাকবে দীর্ঘদিন। আমাকে জানানো হলো আমার পাসপোর্ট নাম্বারটি নাকি অন্যকোনো মামলাযুক্ত পাসপোর্টের সঙ্গে ট্যাগ হয়ে গেছে। ফলে কেন্দ্রীয় সেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যার সুরাহা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সময় যায়। তাদের যোগাযোগ, কথাবার্তা চলতে থাকে। পরিস্থিতির পরিবর্তন নেই। আমিতো ভেবেছিলাম আমার আর এযাত্রায় বুঝি যাওয়া হচ্ছে না। ফিরে যেতে হবে ঢাকায়। তাড়াহুড়ো করে আসাটাই বিফল। তা যাক ঘণ্টা দেড়েক পর সমস্যার সমাধান হলো। এর ফাঁকে চা-বিস্কুটও এলো। সিলছাপ্পর মেরে পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেওয়া হলো। তবে কাষ্টমস বা বিজিবির কাছে তেমন কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। তবে প্রচুর পরিমানে বিজিবি, র্যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর লোকজন ছিল। আগে এমনটি দেখা যায়নি।
নন্দিতার সাথে দেখা
আগরতলায় সেখানেকার পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠজনের অনেকের সঙ্গেই দেখা হলো। অনেকেই আমাদের হঠাৎ করে দেখে রীতিমত বিস্মিত। অনেকেই এসময়টিতে আশা করতে পারেনি আমাদের। সঙ্গত কারণেই ভেবেছিলাম দেশের পরিবর্তীত পরিস্থিতি বিশেষ করে সাম্প্রতিক বন্যা। সে বিষয়ে আমি লেখালেখিও করেছিলাম। সেসব বিষয় নিয়ে ত্রিপুরার সঙ্গে সম্পর্কের একটা টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। আমাদের তারা কিভাবে নেয়-তা ভেবে বিব্রত ছিলাম। তবে প্রথমদিনেই যাদের সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো তাদের আন্তরিকতা আমার ভাবনার ভ্রান্তি বদল হলো। আমন্ত্রণ পেয়ে প্রথমেই গিয়েছিলাম ত্রিপুরার পরিচিত মুখ, বিশিষ্ট ইংরেজির শিক্ষক, বাচিক শিল্পী, উপস্থাপক নন্দিতার (নন্দিতা ভট্টাচার্য) বাসায়। বেশকিছু সময় জমিয়ে আড্ডা। তারপর এবারের পূজায় দৈনিক ত্রিপুরা দর্পণের বিশেষ সংকলনে তার কবিতা ছাপা হওয়ার কথা জানালো। সংখ্যাটি চমৎকার। ৩১৬ পৃষ্ঠা ব্যাপ্তীর চমৎকার প্রচ্ছদের গ্রন্থটি হাতে নেওয়ার মতো। এর সাথে নন্দিতা, তার ‘কখনো বৃষ্টি’ এবং ‘কবিতার সাতকাহন’ নামের দু’টি বইও উপহার হিসাবে তুলে দেয়। আর সন্ধ্যায় চায়ের আপ্যায়নতো ছিলই।
বাড়িতে কুকুর সন্তানের মতো
বাড়িতে কুকুর পালেন অনেকেই। অনেকের কাছে এইসব পালিত কুকুর আপনজনের মতোই। তেমনি সন্তানতুল্য আদরে লালিতপালিত হয় অনেকের বাসায়। লিপিকার বাড়িতেও তেমনি একটি কুকুর আছে। বেশ বড়সড়। ভয় পাইয়ে দেবার মতোই তার আওয়াজ। লিপিকার বাসা আগরতলা শহরের ঐতিহাসিক কর্ণেল চৌমুহনীতে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এ এলাকাটি নানাভাবেই জড়িত। এবার আমি আর খাদি ভবনের সানাই আগরতলা অবস্থানকালে কর্নেল চৌমুহনীর একটি হোটেলে থেকেছি। ফলে সেখান থেকে কাছেই লিপিকাদের বাসা। লিপিকার পুরো নাম লিপিকা ঘোষাল চৌধুরী। সে সেখানকার ওভার সিল ব্যাংকে পদস্থ কর্মকর্তা। তাদের সঙ্গে পরিচয় অনেক বছর আগে। শেষবার দেখা হয়েছিল, সেই করোনার আগে ‘১৯ সালে। সেসময় সানাই ছাড়াও সঙ্গে ছিলো টিটু (টিটু ভূইয়া)। আর তখনো দেখেছিলাম সেই কুকুরটি। কুকুরটি এ বাড়িতে বেশ আরাম-আয়েসেই আছে। তার জন্যে গৃহশিক্ষকও আছে।
লিপিকার সঙ্গে আমার সম্পর্কের আলাদা একটা মাহত্ব আছে। লিপিকা, আমাকে ‘তার মায়ের পেটের ভাই’ বলে সম্মোধন এবং সম্মান করে। এবার তাদের বাসায় যাওয়ার পর আমাকে আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি বই উপহার হিসাবে দিয়েছে। আর সেই বইটিতেও ‘মায়ের পেটের ভাইকে উপহার’ বলে শুভেচ্ছা স্বাক্ষর করেছে। বইটি হচ্ছে ‘দেশ’। কলকাতা থেকে প্রকাশিত এবারের শারদীয় পূজা সংখ্যা। বহু বছর পর ‘দেশ’ পূজা সংখ্যা হাতে পেলাম। এর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেই ছোটবেলায় এই পূজা সংখ্যার সঙ্গে পরিচয়। ঢাকার আগামছি লেনে আমার নানা বাড়িতে দেখতাম বইটি। সেসময় উল্টোরথ, প্রসাদ এধরনের আরো কিছু সাহিত্য নির্ভর বেশ মোটাসোটা বই প্রকাশিত হত। অনেকেরই মনে থাকার কথা। আমার ছোটখালা ফরিদা, খালাতো বোন মনি, সুরাইয়া খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ত বইগুলো। প্রতিবেশী অনেকেই আসত বইগুলো নিয়ে পড়তে। আমি তখন শুধুই পাতা উল্টেপাল্টে দেখতাম। পরে পড়ার বয়স যখন হয়েছে তখন নিজেই কিনে পড়েছি। কিন্তু দুঃখজনক হলো সমৃদ্ধ সাহিত্য-সংস্কৃত নির্ভর এই বইগুলো আমাদের দেশে আস্তে আস্তে দুস্প্রাপ্য হয়ে যায়। তবে আমাদের দেশের বিভিন্ন দৈনিকের ঈদ সংখ্যাগুলো সেই স্থান দখল করে নেয়।
বহু বছর পর লিপিকার বাসায় বইটি পেয়ে খুব ভালো লাগলো। তাদের বাসা এখন একদমই খালি। তাদের একমাত্র সন্তান ডাক্তার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। েেরর সাথে সে থাকে গ্যাংটক। বাসায় তারা দু’জন, স্বামী-স্ত্রী। লিপিকার বর ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। খুবই আলাপী মানুষ। সেদিন তিনি বাসায় ছিলেন। লিপিকা দম্পতির সঙ্গে কথায় কথার বেশ কেটেছে বিকাল থেকে সন্ধ্যা। বৈকালিক চা পর্ব সেখানেই সেরেছি। থাকার জন্যে অনেক বলেছে। বলেছে এতগুলো রুম আমরা দু’জন আর আমাদের কুকুর। তোমরা থাকলে জমবে ভালো।
এস বিস্কুট
খুব সাধারণ। কিন্তু ছেলেবেলা মনে করিয়ে দেওয়ার মনোলোভা, মচমচে,মন-চনমন করার মতোই খাবার। আগরতলা গেলেই এটা সংগ্রহ করতে ভুলিনা। কিন্তু এবার শহরে কোথাও চোখে পড়েনি। এর আগেরবার রবীন্দ্র শতবার্ষিক মিলনায়তনের উল্টো দিকের একটি দোকানে দেখেছিলাম। এবার কোথাও না দেখে একটু মন খারাপ করে ফিরছিলাম। হঠাৎ সেনামুড়া এসে কথাটি আবার মনে হলো। ভাবলাম দেখিনা, সিএনজি ট্যাক্সি চালককে বলে। তার সঙ্গে এমনিতেই কথা হচ্ছিলো। আমি একা যাত্রী। ইমিগ্রেশন চেকপোষ্টের দিকে যাচ্ছি। পথে পথে দু’পাশের ছোট ছোট পুরোনো সব দোকানপাট, লোকজন দেখতে দেখতে চলছিলাম। হঠাৎই মনে হলো চালককেই বলে দেখি না। বললাম, এস কুকিজ বিস্কুট চেনেন, এখানে পাওয়া যায়? তিনি বললেন ‘হ এখানোই পাইলাইবেন দাদা, কুকিজ’। সঙ্গে সঙ্গেই থামালো ট্যাক্সি। রাস্তার উল্টো পাশেই ছোট মতো একটি বাজার। সেখানকার একটি বেকারি থেকেই চালক চটজলদি নিয়ে এলেন আমার কাঙ্ক্ষিত সেই এস বিস্কুট। দেখেই নেমে পড়লাম। তারপর সেদোকানে গিয়ে দু’প্যাকেট নিয়ে নিলাম। আরো বেশি কেনার ইচ্ছে থাকলেও আমার ব্যাগে বহন করার মতো কোনো জায়গা ছিল না। তাই ইচ্ছে থাকলেও বেশি নেওয়ার সুযোগ ছিল না।
ইংরাজি ‘এস’ অক্ষরের সাদৃশ্য এই এস কুকিজ সেই ছোট বেলা থেকেই আমার খুব প্রিয়। একসময় কুমিল্লায় খুব সহজলভ্য ছিল। কিন্তু এখনতো আর দেখাই যায় না। সে স্থান দখল করেছে চট্টগ্রামের প্রায় একই স্বাদের কিন্তু সাইজে ছোট বেলা বিস্কুট আর পরিচিত খাস্তা বিস্কুট। সেই ছোট বেলার মুখে লেগে থাকা স্বাদের সেই ‘এস বিস্কুট’ -কি আর ভোলা যায়? আর এগুলো আগরতলা গেলেই শুধু পাই। আর তাই ফেরার পথে নেওয়া চাই। এবার তা মিস্ হতে হতেও মিলে গেল।
"