রেজাউল করিম শামিম

  ১৮ নভেম্বর, ২০২৪

দূরে কোথাও

স্মৃতিময় আগরতলার কিছু টুকরো স্মৃতি

কুমিল্লার নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। আর তার রাজধানী আগরতলা। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্র্ণ স্মৃতি জড়িয়ে আছে আগরতলাকে ঘিরে। আমার বাড়ি কুমিল্লা শহরে। ফলে সহজেই বিবিরবাজার ইমিগ্রেশন পার হওয়া যায়। আগরতলা যাওয়া-আসা করাও সহজ। আগরতলার সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আবহাওয়া, ভাষা, আচার-আচরণের নৈকট্যও বেশি। এমনকি গোমতীও আমাদের দুই শহরের অভিন্ন নদী। প্রতিবেশীর বাড়িতে যাওয়ার মতো করেই অনেকবার গেছি আগরতলা। ফলে সেখানকার লোকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, তাদের ঘিরে কাটানো স্মৃতিও অনেক। সর্ব শেষবার আগরতলা ঘুরে আসা হলো। একান্ত নিজস্ব স্মৃতিময়তায় ঘেরা সময়ের কিছুটা শেয়ার করছি।

ঘরোয়া ঘনিষ্ঠতার ছোঁয়ায়...

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো দল বা সরকার নয়। জনগণের সঙ্গে জনগষের সম্পর্কের বিষয়টির ওপর গুরত্ব দেওয়ার কথা শুনছি অনেক দিন ধরে। ইদানীং একটু বেশিই শোনা যায়। কথাটি আমারও খুব পছন্দের। কিন্তু এটা শুধু বলার জন্যে বলা বা কূটনৈতিক ভাষ্য না হয়ে, বাস্তব হওয়াটাই জরুরি। তবে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ত্রিপুরার জনমানুষের সঙ্গে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার চেষ্টা আমার বরাবরই রয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমি সংস্কৃতিমনা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার আগরতলা গিয়ে বিষয়টি আরো গভীরভাবে উপলব্ধি হলো।

আমি ও সানাই আগরতলায় গেছি খবর পেয়ে মৌসুমী আমাদের নিমন্ত্রণ করে তাদের বাসায়। মৌসুমীর পুরো নাম মৌসুমী কর। সে জনপ্রিয় কবি, আকাশবাণী আগরতলাসহ স্থানীয় ইলেকট্রনিকস নিউজ পোর্টালের উপস্থাপক-সংঞ্চালক। এ ছাড়া সে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত। মোটকথা, সেখানকার অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং পরিচিত মুখ। মৌসুমী, আগরতলার একটি ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান। তার প্রয়াত বাবা, ত্রিপুরা রাজ্যের প্রখ্যাত সাংবাদিক মৃণালকান্তি কর। আর মা ছবি দেববর্মা ছিলেন, মিউজিক কলেজের প্রতিষ্ঠাতা, অধ্যক্ষ পুলিন দেববর্মা।

সেদিন মৌসুমীদের ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক বাসভবনে গিয়ে আমাদের তো বিস্ময়ের শেষ নেই। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন, সবিতা স্মৃতি মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি শিক্ষক, বিশিষ্ট কবি এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক গৌরাঙ্গ চন্দ্র দেবনাথ, কবি মৃণাল কান্তি পন্ডিত, সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব কৌশিক ভৌমিক, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, বাচিক শিল্পী নন্দিতা ভট্টাচার্য, সমাজসেবক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সঞ্জীব রায় চৌধুরী।

আমার জন্য বিস্ময়কর এবং কিছুটা বিব্রতকর ছিল তাদের আন্তরিক আনুষ্ঠানিকতা। রীতিমতো পুষ্পস্তবক দিয়ে স্বাগত জানানো থেকে শুরু করে উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া এবং আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি আর সামাজিক সম্পর্কের অতীত আর বর্তমান নিয়ে আলোচনা। এর ফাঁকে ছিল বৈকালাক চা-নাশতা। আর নৈশভোজ হিসাবে মৌসুমীর তৈরি ‘বাসন্তী পোলাও’।

এখানেই শেষ নয়। শেষাংশে ছিল মৌসুমীর দুটি কবিতার বই ‘তোমাকে ছুঁয়ে গোধূলি এসেছে’ এবং ‘বিচিত্র ককটেল’ উপহার। সেসঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মৈত্রী সংসদ’র প্রকাশিত আন্তর্জাতিক স্মারক গ্রন্থটি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া। গ্রন্থটিতে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক ড. আলী হোসেন চৌধুরীর একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণালব্ধ প্রবন্ধও রয়েছে। দুটি প্রতিবেশী দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার এমনি অসাধারণ উদাহরণ দীর্ঘদিন মনে থাকবে।

প্রয়োজন আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি

সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যা, এবার আগরতলায় খুবই আলোচিত বিষয় ছিল। বিশেষ করে সেখানকার একটি বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার কারণে আমাদের এখানে বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল- এ বিষয়টি সেখানকার নাগরিকদের মনে খুবই রেখাপাত করেছে। বিষয়টি তারা মেনে নিতে পারছে না। সেদিন আগরতলার উড়ালপুল দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় বলছিল রাজিব চক্রবর্তী। রাজিব, আমার দীর্ঘকালের পরিচিত-ঘনিষ্ঠজন নিবেদিতার বর। তাদের সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক। ফলে আগরতলা এলে, এই দম্পতির সঙ্গে দেখা হবেই। আর তারা সেখানকার কোনো না কোনো অভিজাত হোটেলে নিয়ে আমাদের মধ্যাহ্ন কিংবা নৈশভোজে আপ্যায়ন করাবেই।

এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। শহরের বাইরে হাপানিয়া এলাকার একটি বড় রেস্টুরেন্টের নাম ‘নির্মলা’। সেখানে দুপুরের খাওয়ার পরই রাজিব, আমাদের নিয়ে তার গাড়ি চালাচ্ছিল। শহরের একমাত্র উড়ালপুল দিয়ে যেতে যেতে নিবেদিতা আর রাজিব বলছিল, তাদের এলাকার এবারের বন্যার ভয়াবহতা আর দুর্গতির কথা। আমি আর সানাই শুনছিলাম। তারা জানাল, তাদের গোটা ত্রিপুরা তো এমনিতেই উঁচু এলাকা। বন্যা হয় না বললেই চলে। যার জন্য বন্যা মোকাবিলার মতো প্রস্তুতি সেখানে তেমন নেই। নেই বন্যায় ত্রাণকাজ চালানোর মতো নৌকা, ট্রলারের মতো জলযান। কিন্তু এবারের অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল মারাত্মক বন্যার সৃষ্টি করে। সরকারি কিছু রাবারের লাইফবোর্ডসহ ষড়ঞ্জাম দিয়ে উদ্ধার এবং ত্রাণ কাজ চালানো হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল অনেক কম। বিশেষ করে লাগাতার বন্যায় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানোই ছিল অনেক কষ্টসাধ্য। জল চারদিকে এতটাই ফুলেফেপে উঠেছিল যে, তা ডিঙিয়ে জলবন্দি দুস্থ মানুষের কাছে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো বা স্ব-উদ্যোগে খাদ্য সংগ্রহ করা যাচ্ছিল না।

নিবেদিতা জানায়, তাদের রামনগর এলাকাটি অপেক্ষাকৃত উঁচু। তার পরও তাদের বাড়ির নিচতলায় জল উঠে যায়। অন্যান্য এলাকার কথা সহজেই অনুমান করতে পারেন। যার জন্যে দরিদ্রজন তো বটেই অনেক সামর্থ্যবান লোকজনকেও দু-তিন দিন উপোস করতে হয়েছে। তাদের এসব বন্যার বর্ণনা দিয়ে পরের কথাগুলো বলল আমাদের লক্ষ করে। তারা জানায়, এখানকার মানুষের যখন এমনি দুর্বিষহ অবস্থা, এ অবস্থায় ইচ্ছা করেই কি কুমিল্লাসহ অন্যান্য এলাকা বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া সম্ভব? ওইসব এলাকাতেও এখানকার অনেকেরই আত্মীয়স্বজন রয়েছে। আসলে এখানকার উঁচু এলাকার জল নিচু এলাকা দিয়ে নামবে- এটাই তো স্বাভাবিক। আর বাস্তবে তাই হয়েছে। কিন্তু আপনাদের এলাকার লোকজনকে বলা হয়েছে, প্রচার করা হয়েছে সেখানকার বন্যার জন্য ত্রিপুরাই দায়ী।

আমি বললাম, জল যাবে তলের দিকে- এটা ঠিক আছে। তবে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের একটা বিষয়তো রয়েছে। আমাদের ওখানকার লোকজনের এটা জানা হয়ে গেছে, ত্রিপুরার ডুম্বুর নামক স্থানে উঁচুতে একটি বাঁধ আছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অতি বৃষ্টি বা পাহাড়ি ঢলের সময় এ গেট খুলে দেওয়া হয় অথবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেট খুলে যায়। আর সেই পানিই গোমতী উপচে প্লাবনের সৃষ্টি করে। হঠাৎ করে এত পানি ধারণ করা বা বয়ে নেওয়ার ক্ষমতা গোমতীর থাকে না। ফলে বাঁধ উপচে, কখনো পাড় ভেঙে দুপাড়ের বন্যার সৃষ্টি করে। জনপদ ভাসিয়ে নেয়, ডুবিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনে। এ বছর যেমনটি হয়েছে।

এখন কথা হলো উজানের পানি ভাটিতে গড়াবেই। আবার আলোচ্য বাঁধ তো ভেঙে দেওয়াও যাবে না। বিদ্যুতের প্রয়োজনে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভাটি অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে আস্থার বোধ জাগাতে হলে যেটা করণীয়- তা হলো : বন্যায় উজান থেকে শুধুই পানি তো নেমে আসে না। সে সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বালি, পলিমাটি ইত্যাদিও ভেসে আসে, যা জমে জমে গোমতীর তলদেশ ভরাট হওয়া থেকে শুরু করে দুপাড় সংকীর্ণ করে ফেলেছে। ফলে গোমতী আজ শীর্ণকায় প্রায় খালে পরিণত হয়েছে। হঠাৎ করে এত পানি ধারণ করা বা বয়ে নেওয়ার ক্ষমতা গোমতীর নেই। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো নদী সংস্কার। অর্থাৎ খনন করে পানির ধারণক্ষমতা এবং প্রবহ বৃদ্ধি করা। কিন্তু যা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে যেহেতু এর সঙ্গে ত্রিপুরার দায় রয়েছে। সেহেতু এর ব্যয় যৌথভাবে কুমিল্লার পাশাপাশি ত্রিপুরাও বহন করতে পারে।

একইভাবে রাজিবদের বললাম, তোমাদের রামনগরের মতো অভিজাত আবাসিক এলাকার প্রয়োবর্জ্য কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের আখাউড়া, কসবা এলাকায় গিয়ে পড়ছে। সেখানকার নদী-নালাগুলোকে মারাত্মক দুষণের কবলে ফেলছে প্রতিনিয়ত। ফলে সেখানকার কৃষিকর্ম থেকে শুরু করে ঘরগৃহস্থালী কাজে লোকজনের স্বাভাবিক জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আর এ সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে বহমান। এ নিয়েও জনগণের মধ্যে রয়েছে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।

আমাকে থামিয়ে রাজিব বলল, সেখানে তো এ সমস্যা সমাধানের জন্য সীমান্তের যে এলাকায় পয়োনিষ্কাশন হয়, সেখান ন্যাট দেওয়া হয়েছে। আমি বললাম, তাতে হয়তো বড় কিছু বর্জ্য বা বড়সড় আবর্জনা আটকানো যায়। কিন্তু তাতে তো দূষণ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এর জন্য প্রয়োজন এ্যটিপি প্ল্যান্ট বসিয়ে প্রয়োসোধন করে তারপর পানি ছাড়া। এসব সমস্যাগুলো সমাধানের জন্যে ত্রিপুরার জনগণের পক্ষ থেকে আওয়াজ তোলা, দাবি তোলা জরুরি। এর মধ্যদিয়েই আমাদের এলাকার জনগণের ক্ষোভ, ভুল বোঝাবুঝির অবসান আর উভয় দেশের জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরে আসা সম্ভব। এর আগে অন্যান্যদের সঙ্গে আলোচনার সময়ও বন্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলো উঠে এসেছিল। যাক নিবেদিতাদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া, আলোচনা আর শহর দেখার মধ্যদিয়ে ভালোই সময় কেটেছে।

* বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close