মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
কণ্ঠের জাদুকর মাসুম
বাইকওয়ালা পোলাপান আমার ভালো লাগে না। ব্রাজিল এমন একটা দল যারা সফল হয়েও সমালোচিত। একবিংশ শতাব্দীতে পাঁচ-পাঁচটা বিশ্বকাপ জেতার পরও ব্রাজিলকে নিয়ে সমালোচনা যেন শেষ হয় না। ছবির লোকটির নাম সাদিও মালে। একজন ফুটবলার। ফেসবুকে স্কল করতে গিয়ে এমন ভরাট গলার কণ্ঠ যদি আপনাকে স্পর্শ করে। কণ্ঠের মুগ্ধতায় ভিডিও পুরোটাই দেখতে উদ্বুদ্ধ হন। তাহলে জেনে নিন নেপথ্যে কণ্ঠ দেওয়া এই মানুষটির নাম মিনথাল আহমেদ মাসুম। পেশায় একজন ব্যাংকার, নেশায় ভয়েস ওভার আর্টিস্ট। তার কণ্ঠ দেওয়া কনটেন্ট বেশির ভাগই মিলিয়নের ওপর ভিউ। বহুমুখী প্রতিভার একজন মানুষ মাসুম। দেশের জনপ্রিয় কয়েকটি টিভি চ্যানেলে নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে কাজ করেছেন। জনতা ব্যাংকে কাজ করেছিলেন কিছুদিন। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজের পাশাপাশি সময়ে ভয়েস ওভার আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেন।
গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ হলেও ঢাকার মাতুয়াইল মাদরাসা বাজার এলাকায়। মাতুয়াইল আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, কবি নজরুল সরকারি কলেজ থেকে সফলভাবে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স, মার্স্টাস করতে একটুও বেগ পেতে হয়নি তাকে।
নিউজ প্রেজেন্টারের কাজ করতে ভালোই লাগছিল তার। কিন্তু পড়াশোনার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন। তখন ভাবলেন বাসায় বসে কিছু উপার্জন করা যায় কি না। আর টিভিতে তো মানুষ দেখেই। কণ্ঠ শুনে মানুষ চিনলে ভালোই হয়। সেই ভাবনা থেকে দু-একটা ইউটিউব চ্যানেলে ভয়েস ওভার দেওয়া শুরু করেন। এরপর দিনের পর দিন ভয়েস ওভারের কাজ তার বাড়তেই থাকল। এক হাজারেরও বেশি ভয়েসওভার দিয়েছেন। ফ্রিল্যান্সার ভয়েস আর্টিস হিসেবে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তিনি অসংখ্য পেজ, ইউটিউব চ্যানেল, টিভি চ্যানেল, অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে ভয়েস দিয়েছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু হলো, মাছরাঙা টেলিভিশন (১ দশমিক ৫ মিলিয়ন), পেরিস্কোপ ভিডিওস (১ মিলিয়ন+), দুরবিন (১ দশমিক ৮ মিলিয়ন), দুরবিন ওয়ার্ল্ড (৫৭১-কে), ধুলাবালি (৬৯৫-কে), দশমিক (২৭৭-কে), খেলার মেলা (১৮৮-কে), ফাপরবাজ ফান (১ দশমিক ৮ মিলিয়ন), খেলাধুলা (৩৬১-কে) আলোড়ন (৪১২-কে), পূর্ব-পশ্চিম (৬৩৩-কে), সেলিব্রিটি স্টোরি (৮৯-কে), এফপিবি নিউজ (৫৫৩-কে), বাংলা হিস্টোরি (৭৯৮-কে), পটিয়া প্লাস টিভি (১৮২-কে), আল ইজতিহাদ (১ দশমিক ২-কে), ইনক্রেডিবল বাংলা (২২-কে সাবস্ক্রাইবার), টি স্পোর্টস চ্যানেল। বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষাতেই তিনি ভয়েস দেন। আইভিআর, প্রমোশনাল, কলারটিউন, অডিওবুক, নিউজ, অ্যাডভার্টাইজিং, কমার্শিয়াল, ওভিসি সব কনটেন্ট- এসবের কোনোটাই তার কাজের বাইরে নেই।
ভয়েস ওভার আর্টিস হিসেবে মাসুমের প্রথম কাজ ছিল একটি ইউটিউব চ্যানেলের। সে ২০২০ সালের ঘটনা। তখন তিনি ১০ হাজার টাকা পেতেন। এখন তার মাসিক আয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। তবে আয়ের চেয়েও কাজটা বেশি উপভোগ করেন তিনি। ভয়েসওভারিং তার প্যাশনের কাজ।
ভরাট, সুন্দর কণ্ঠ থাকলেই হয় না। ভয়েসওভারিংয়ের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় জানতে হয়। মাসুম সে জন্য বাংলাদেশ ইস্টিস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্র্রনিক মিডিয়া থেকে তিন মাসের্র কোর্স সম্পন্ন করেন। যেখানে নিউজ প্রেজেন্টেশন/ভয়েসওভারিংয়ের মৌলিক বিষয়গুলো শিখেছেন। গড়ে মাসুমের কনটেট ভিউ মিলিয়ন। তবে সবচেয়ে বেশি প্রায় ২৫ মিলিয়ান ভিউ হয়েছে ফাপরবাজ ফান পেজের একটি ভিডিও। চাকরির পাশাপাশি সময় বের করে ভয়েজ ওভারের কাজ করেন মাসুম। তার ফেসবুক আইডি, পেজ Minthal Speaks-এর ইনবক্সে মানুষ কাজের জন্য যোগাযোগ করে থাকে। বাংলাদেশে ভয়েসওভার আর্টিস্টেদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে দক্ষ ভয়েজ আর্টিস্ট হতে পারলে কাজের অভাব হয় না।
মাসুম জানান, ভয়েসওভারিংয়ে ভালো দক্ষতা থাকলে বিভিন্ন অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি, ফেসবুক পেজ, ইউটিউব চ্যানেলসহ অনলাইন এবং অফলাইনে প্রচুর কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়।
মাসুম মনে করেন, একজন ভয়েস ওভার আর্টিস্টের সাবলীলভাবে শুদ্ধভাবে রিডিং পড়ার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে সবার আগে। তারপর প্রচুর অনুশীলন করতে হবে। স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী এক্সপ্রেসন দেওয়ার গুণ রপ্ত করতে হবে। পাশাপাশি কণ্ঠটা ঠিকঠাক রাখার জন্য যত্ন করার দরকার আগে। ঠান্ডা লাগলে বা গলা বসে গেলে কাজ করা যায় না। তিনি কণ্ঠের যত্নে গরম পানি এবং মধু খান মাঝে মাঝে।
শুধু বাংলাদেশ নয়। বাইরের দেশের কোম্পানির ভয়েসওভারিংয়ের কাজ করেছেন তিনি। কিছুদিন আগেও কানাডাভিত্তিক একটা সফটওয়্যার কোম্পানির বাংলা এবং ইংরেজি ভাষার আইভিআরে ভয়েসওভারের কাজ করেন তিনি।
চোহারায় না চিনলে কণ্ঠে মানুষ চেনে। প্রশংসা করে। এসব মাসুমের ভালো লাগে। তবে দুঃখের ঘটনা হলো, কাজের পর অনেক ক্লায়েন্ট ঠিকঠাক পেমেন্ট বুঝিয়ে দেয় না। টালবাহানা করে। তখন তার খুব
খারাপ লাগে। তবে বেশির ভাগ ক্লায়েন্ট এমনটা
করেন না বলে তিনি জানান। ভয়েস
ওভারিংয়ের কাজের পাশাপাশি মাসুম একজন ফ্রিল্যান্সারও। তিনি ইমেইল মার্কেটিং (ইমেইল সিগনেচার তৈরি, ইমেইল টেমপ্লেট তৈরি,
মেইলচিম্প অটোমেশন) ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন। অনেকেই ভয়েসওভারের কাজ শিখতে চায়। তাদের জন্য মাসুস একজনকে সঙ্গে নিয়ে কনটেন্ট ক্রিয়েশন ওয়ার্কশপ করেছেন। প্রথম ব্যাচে ৪০ জন শিক্ষার্থী ছিল। মাসুম জানান, তাদের হাতে-কলমে ভয়েসওভারসহ কনটেন্ট মেকিংয়ের খুঁটিনাটি বিষয় শেখানো হয়েছে।
নিজেকে দেশের নম্বর ওয়ান ভয়েস আর্টিস্টের জায়গায় নিয়ে যাবেন। ভয়েসওভার ইন্ডাস্ট্রিতে নেতৃত্ব দেওয়াসহ সুযোগ পেলে বড় বড় অ্যাডভার্টাইজিং বা নিউজ এজেন্সিগুলোর সঙ্গে কাজ করবেন। আপাতত এগুলোই তার আগামী দিনের ভাবনা।
"