সেলিনা আক্তার

  ০৭ অক্টোবর, ২০২৪

মেডিটেশন সুখ-শান্তির উৎস

কবি জালাল উদ্দীন রুমি প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে গভীর মনোযোগের সঙ্গে একটা বই পড়তেন। বই পড়া শেষ হলে সে বই লুকিয়ে রাখতেন বালিশের নিচে। তার বিভিন্ন সৃষ্টি নিয়ে ভক্তদের সঙ্গে কথা বলতেন। জ্ঞান বিতরণ করতেন, কিন্তু এ বই সম্পর্কে কাউকে কিছু বলতেন না। তার ভক্তরা নাছোড়বান্দার মতো চালের ওপর দিয়ে, দরজার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন। যখন মারা গেলেন, তার লাশ রেখে সবার নজর ছিল বালিশের নিচে বইয়ের প্রতি। শোক ভুলে সবাই আগে বই খুঁজতে শুরু করল। বই দেখল। হাতে নিয়ে দেখা গেল, সেটা পুরো সাদা পাতার একটা বই। তাতে কিছু লেখা নেই। অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা উনি এটি পড়তেন। এটি আসলে ছিল একই ধরনের ধ্যান। এ ছাড়া তিনি টানা ছত্রিশ ঘণ্টা ঘুরতে ঘুরতে নেচেছেন এবং যখন পড়ে গেছেন তখন বন্ধ হয়েছে তার নাচ। সবাই ভেবেছে কবি পাগল হয়ে গেছেন, কিন্তু দেখা গেল তার চেহারা আরো জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছে। যেন বয়স কমে গেছে। বরং যারা দেখেছে আশপাশের অনেকে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল। এ ছিল তার আত্মিক মগ্নতা। এক ধরনের ধ্যান বা মনোনিবেশ।

২০১৮ সালে ভারতীয় পাঠ্যক্রমে সুখ নামে একটি বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে। এটি সিএনএন নিউজে এসেছে। এতে বাচ্চাদের কীভাবে পাঠ্য বিষয়ে ধ্যান করতে হয় এবং সুখ যে একটা নিজস্ব বিষয়, সে সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া হয়। আমরা বাচ্চাদের বলি, পড়ায় মন দাও। ধ্যান দাও। কিন্তু বাচ্চারা কোথায় পড়ায় ধ্যান দেয়? আসল কথা ধ্যান দিতে হয় কীভাবে সেটাই তারা জানে না। এ জন্য তাদের এই নতুন শিক্ষাক্রমের শুরু হয়। স্কুলে এক ঘণ্টা হয় এই ধ্যান-জ্ঞানের ক্লাস। ‘আম্মা বলেন পড়রে সোনা, আব্বা বলেন মন দে; পাঠে আমার মন বসে না কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।’

মন তো কবির মতো কাঁঠালচাঁপার গন্ধে আউলা হবেই। কিন্তু জগৎ সংসার ভুলে মনটাকে কীভাবে সেট আপ দিতে হয়, তা জানলে অনেকখানি সহজ হয়ে যায়। এ জন্য প্রয়োজন মেডিটেশন। তবে শুধু যে পড়ায় মনোযোগের জন্য ধ্যান বা মেডিটেশন প্রয়োজন, তা নয়। জীবনের ছোট ছোট অকৃতকার্য মুহূর্তকেও কীভাবে কাটানো যায়, বেদনাসিক্ত হয়েও কীভাবে হাসা যায়, তার জন্য প্রয়োজন মেডিটেশন। ভারতে এমনতর পদ্ধতি চালু করার যথেষ্ট কারণ অবশ্য আছে। সেখানে তরুণদের আত্মহত্যার হার, হতাশার হার মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। জলবায়ুগত মিল, ভৌগোলিক মিল ছাড়াও কৃষ্টি সংস্কৃতিসহ সে দেশের অনেক কিছু সঙ্গে সম্পৃক্ততা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। সময় এসেছে আমাদেরও বদলানোর। শুধু পড়ায় মনোযোগ না জীবনের অনেক কিছুই পাল্টে দেয় ধ্যান।

অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটা কথা বলে রাখি, ১৯৯৯ সালে আমি বেশ বড় ধরনের অসুখে পড়ি। সেটা ছিল বোন টিউমার। তখন বলা যায়, মেডিটেশন চর্চা চারদিকে ছড়াচ্ছিল। ভালো হয়ে ঢাকা অফিসে কাজ শুরু করেছি আবার। আমার এক চাচা খুব জোর করলেন মেডিটেশন করতে। তখন ব্র্যাক সেন্টারের কোনো একটা ফ্লোরে সেশন বসত। আমি প্রচণ্ড বিরক্ত হলাম। গেলাম তো না, উল্টো এড়িয়ে গেলাম। তবে বহু বছর পর বলা যায়, আমেরিকায় আসার পর আমি আধ্যাত্মবাদ নিয়ে কিছু পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখি, মেডিটেশনের সঙ্গে এর যোগ-সংযোগ খুব বেশি। মেডিটেশন এসেছে আধ্যাত্মবাদ থেকে। আর এখন আধ্যাত্মবাদকে মনোবিজ্ঞান মানুষের কল্যাণের ব্যবহার করছে।

সাধারণভাবে মনে করা হয়, জীবনে একটা দুর্বল মুহূর্ত এলেই মেডিটেশন প্রয়োজন। অথবা বয়স চল্লিশের ওপর গেলে করতে হবে। কিন্তু শেষ বয়সে জীবনের জ্ঞান ধ্যানের চেয়ে শুরুতে এসব আয়ত্ত করতে পারলে জীবন হবে অন্য রকম। তবে এটা ঠিক, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যখন মেডিটেশন কিছু ক্ষেত্রে আসতে শুরু করল, তখন বিভিন্ন সেন্টার থেকে হাসপাতালের রোগীদের কাউন্সেলিং করা হতো। কিন্তু সময় পাল্টেছে, এখন সুস্থ থাকার জন্য বলা যায় আমজনতার না হোক, সচেতন জনগোষ্ঠীর অনেকে মেডিটেশন করছেন। এমনকি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের এ সব দলগতভাবে দেওয়া হচ্ছে। যদিও এর ইতিহাস এবং বস্তুগত মর্ম অনেক বড়। এর মূল মন্ত্র হচ্ছে নিজেকে সময় দেওয়া, নিজেকে জানা-চেনা। একজন মানুষ যখন নিজেকে চিনেতে পারবে, তখন সে বাকি সবাইকে চিনতে পারবে। যেকোনো পরিস্থিতিকে সে সানন্দে গ্রহণ করতে পারবে।

ছোটবেলা থেকে আমরা শিখে যাই, খুশি কীভাবে মিলে? পিকনিকে গেলাম খুশি। ঈদ, পূজা এলো তো খুশি। কেউ কিছু দিলে তো খুশি। বলা যায়, আমাদের এভাবেই কোডিং করা হয় খুশি মানে কিছু পাওয়া। পরীক্ষার মার্ক ভালো তো খুশি। কম এলো তো খুশির স্কেল নিচে নামতে থাকে। এখন কিছু পেলাম না বলে কী আমার জীবনে খুশি থাকবে না? এই জিনিসটা আমাদের শেখানোই হয় না। আমাদের মন অকারণে খারাপ, আবার ঠিক ওই মুহূর্তে কিছু পেলাম বা কোথাও গেলাম ভালো। এই সুখ আসলে স্থায়ী নয়। এগুলো সাময়িক আনন্দ দেয়, কিন্তু আত্মাকে পূর্ণতা দেয় না। আত্মার পরিশুদ্ধি তখনই সম্ভব, যখন কিছু সময়ের জন্য নিজের ভেতর, সৃষ্টির ভেতর ডুব দেওয়া যায়। একটা মোবাইল যেমন প্রতিদিন চার্জ না করলে দিন চলে না, তেমনি মানুষের মন অর্গানাইজ না করলে, চার্জ না করলে তা ডাউন হতেই থাকে। একসময় যখন চার্জ থাকে না, তখন তা সহজে আমাদের দুঃখী করে দেয়। মেডিটেশন মনকে শান্ত রাখতে সাহায্য করে।

বিনা শর্তে নিজেকে সুখী ভাবা বা খুশি রাখা একটা শিল্প, যা দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়। আর এ ধরনের অনুভূতির জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন মনের স্থিতি। কোনো পরিস্থিতি যেন আমাদের মনের গতিধারা বদল করতে না পারে। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে মনকে শান্ত রাখা খুবই জরুরি। সমস্যাকে সমস্যা নয়, দেখতে হবে পরিস্থিতি হিসেবে। একে একটা সম্ভাবনা হিসেবে নিলে আর সমস্যা মনে হবে না। কিন্তু আমরা বলি, আমার এ সমস্যা, আমি সমস্যায় আছি। আমরাই জীবনের ডাইমেনশনকে আগেই একটা নেতিবাচক চিন্তা দিয়ে দিই। এটি যে মোকাবিলা করে পরিবর্তন করা যায়, তা ভাবার মতাে মানসিক স্থিতি থাকে না। পরিস্থিতির ওপর আমরা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর হয়ে পড়ি এবং সেভাবেই প্রতিক্রিয়া করি।

অনেক ক্ষেত্রেই জ্ঞান গভীর বার্তাগুলো নিছক পুঁথিগত জ্ঞান হিসেবেই মনে হয়। এমনকি শুনলেও মনে হয় বিরক্তির উদ্রেক করছে। তবে এসব আসলে শুধু জ্ঞানের বাণী নয়। জীবনবোধের প্রতি মুহূর্তের ভঙ্গুর অংশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। আমাদের সামনে এখন এত বেশি তথ্য যে, এগুলো নানাভাবে আমাদের মনকে প্রভাবিত করছে। চাপ সৃষ্টি করছে, যা মানসিক বা আবেগীয় স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে। মনের চাপ একসময় শরীরে রোগ তৈরি করছে। জ্ঞানীরা এ জন্য বলছেন, শুধু শরীরের খাদ্যের ডায়েট নয়, মনের খাদ্যের জন্যও ডায়েট তৈরি করতে। ঘুম থেকে উঠে অন্তত দুঘণ্টা খবরের কাগজ পড়া, টিভির খবর দেখা থেকে বিরত থাকতে। সামাজিক মাধ্যমেও না আসতে। আপনি সবার সতেজ মনে যা দেখবেন, শুনবেন, পড়বেন তা আপনার দেহ-মন-আত্মা কনজিউম করবে বা শোষণ করবে এবং আপনার জীবন সেভাবেই প্রবাহিত হবে।

যেমন কেউ যখন ঘুম থেকে উঠেই দেখে দুর্ঘটনার বর্ণনা। গাড়ি চালাতে গিয়ে সারাক্ষণ ভয়ে থাকে, কখন না দুর্ঘটনা ঘটে! গবেষণায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে ভয় নিয়ে চালানোর জন্য। যারা বেপরোয়া চালায় তাদের ক্ষেত্রে কম ঘটে। যত ধরনের দুঃসংবাদ আসে বিভিন্ন মাধ্যমে, তা সরাসরি মনকে প্রভাবিত করে। সকাল বেলা মন সে সব শোষণ করে এবং সেভাবেই তা শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জীবনে ফেলে।

সকাল বেলা অন্তত আধঘণ্টা মেডিটেশন করে জ্ঞানের কথা বার্তা বা যে যার ধর্মীয় বাণী শুনতে পারেন। মনই হচ্ছে শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করার মূল উৎস। এসব কথা আপাতদৃষ্টিতে শুনলে মনে হবে ঠিক আছে, কিন্তু মানা বা পালন করা একটু নয় বেশ কঠিন। এই পালনের জন্য, নিয়ন্ত্রণের জন্যও প্রয়োজন ধ্যান। আমি খুব সংক্ষেপ বিষয়টা সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি মাত্র। মেডিটেশন প্রথমেই শেখায়, কীভাবে নিজে ভালো থাকবেন। আপনি ভালো থাকলে আপনার আশপাশের সব ভালো থাকবে। আশপাশের সব বলতে নিজের ঘর বা অফিসের একটা বড় পরিবার হতে পারে। এভাবে পুরো সমাজ ভালো থাকতে পারে। পুরো সমাজ ভালো থাকলে পুরো দেশ ভালো থাকবে। দেশ ভালো থাকলে পুরো পৃথিবীটা ভালো থাকবে। আসুন মেডিটেশন করুন, সুন্দর হন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close