মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

নিরামিষের মিলনমেলা ‘জগন্নাথ ভোজনালয়’

তাঁতিবাজারের এই হোটেলটির যাত্রা ১৬ বছর আগে নিতাইপালের হাত ধরে। সবাই তাকে নিতাইবাবু বলেই ডাকত। করোনায় মৃত্যুর পর হোটেলের মালিকানা হাত বদলায়। বর্তমানে এটির তত্ত্বাবধানে আছে অশোক কবিরাজ

ঢাকা মহানগরীর অলিগলিতে হাঁটলে চোখে পড়বে হাজারো খাবারের দোকান। আর সেটি যদি হয় পুরান ঢাকার গলি- তবে তো কোনো কথাই নেই। মনে হবে যেন খাবারের গলিতে আপনি এক ভোজনরসিক পথিক।

পুরান ঢাকায় কাচ্চি-লাচ্ছি, বাকরখানির দোকানের পাশাপাশি সবারই চোখ আটকে যাবে সম্পূর্ণ নিরামিষ খাবারের দোকান জগন্নাথ ভোজনালয়ে। যেখানে আমিষের কোনো ছিটে-ফোঁটাও নেই। যেন নিরামিষের মিলনমেলা বসেছে জগন্নাথ ভোজনালয়ে।

পুরান ঢাকার তাঁতিবাজারের শিবমন্দির থেকে ডান দিকে একটু এগোলেই সামনে পড়বে নিরামিষের এই ভোজনালয়টি। তাঁতিবাজার এলাকার বাকি নিরামিষ হোটেলের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় জগন্নাথ ভোজনালয়। ওপরে বৈদ্যুতিক খুঁটি আর কালো তারের বেড়াজালে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছে একটি সাইনবোর্ড। তাতে লেখা ‘জগন্নাথ ভোজনালয়’।

গলির পাশের ভবনের দোতলার চিপা সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই দেখা মেলে নিরামিষভোজীদের প্রিয় এই ভোজনালয়টি। সেখানে রয়েছে ৪-৫টি টেবিল আর প্রতি টেবিলে ৪-৫টি চেয়ার সংযুক্ত করা। সাধারণ মানের ছোট ছিমছাম এই হোটেলটিতে একসঙ্গে জায়গা হয় প্রায় ৩৬ জনের।

নিরামিষ ভোজের আস্তানাখ্যাত এই জগন্নাথ ভোজনালয়ে কয়েকটা টেবিল, তার চারপাশে চেয়ার। কিন্তু যে ব্যাপারটা সবচেয়ে চোখে পড়বে সেটা হলো টেবিলের ওপরে বাটির সংখ্যা। ছোট অসংখ্য বাটি সাজানো টেবিলের ওপর। এ রকম ছোট ছোট বাটিতেই পরিবেশন করা হয় হরেক পদের নিরামিষ তরকারি ও ভর্তা।

ভর্তার লিস্ট অর্ডার করলেই চোখের সামনে হাজির হয়ে যাবে বাহারি রকমের নিরামিষ খাবার। আর সঙ্গে স্টিলের থালে ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত। ভাত বা অন্ন প্রথম প্লেট ১৫ টাকা পরবর্তী হাফ প্লেট ৫ টাকা করে। টেবিলে সাজানো বাটি থেকে নিজ ইচ্ছামতো নিয়ে নিয়ে খাওয়া যায় এই ভোজনালয়ে।

জগন্নাথ ভোজনালয়ে ৮-১০ রকমের ভর্তা পাওয়া যায়। যার মধ্যে অন্যতম বেগুন ভর্তা, আলু ভর্তা, ধনে পাতা ভর্তা, শিম ভর্তা, সরিষা ভর্তা, কচুরলতি ভর্তা ইত্যাদি। তা ছাড়া হরেক রকমের শাক পাবেন আপনি এই ছোটা দোকানটিতে, তার মধ্যে অন্যতম লালশাক, পুইশাক, পালংশাক ইত্যাদি। কয়েক রকমের ডাল পাবেন, তার মধ্যে মটর ডাল, মুগ ডাল, বুটের ডাল, মাসকলাই ডাল ইত্যাদি। তা ছাড়া তরকারি, ছানা, বড়া, পনির, সয়াবিনসহ রয়েছে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার। প্রতি বাটি ভর্তার দাম ১০ টাকা এবং ছোট বাটি তরকারি অথবা ভাজি ২০ টাকা এবং বড় বাটিতে ফুলকপি, ভাজি ৩০ টাকা। বড় বাটি তরকারি ৪০ টাকা। এ ছাড়া রয়েছে পাপড় ভাজা, যা ১০ টাকা পিস বিক্রি হয়। এখানকার ১৫০ থেকে ২০০ টাকার খাবারে যে কেউ তৃপ্তি নিয়েই উদরপূর্তি করতে পারবেন।

জগন্নাথ ভোজনালয়ের বাইরেটা দেখে বিভ্রান্ত হলেও ভেতরের পরিবেশ একদমই নীরব সুনশান। সবাই ইচ্ছেমতো খাবার খাচ্ছেন আর বিল দিয়ে চলে যাচ্ছেন। ভোজনালয়টিতে প্রতিদিন সকাল ৮.৩০ থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খাবার পাওয়া যায়। দোকানটিতে খাবার পরিবেশনের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন ৮ জন কর্মচারী। প্রতিদিন এখানে প্রায় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার খাবার বিক্রি হয়।

জগন্নাথ ভোজনালয়ে নিয়মিত খেতে আসা ওমর ফারুক বলেন, আমি নিয়মিত এখানে খেতে আসি, এখানকার খাবার গুণে ও মানে ভালো এবং দামও কম। আর ওদের খাবার পরিবেশনটাও খুব লাগে। ১০০ টাকা দিয়ে যে কেউ দুপুরে পেট ভরে নিরামিষ খেতে পারবে।

জগন্নাথ ভোজনালয়ে বান্ধবী শতাব্দী রায়কে নিয়ে খেতে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিথিলা দেবনাথ ঝিলিক বলেন, এখানকার পনির, সয়াবিন আর বড়াটা খুবই সুস্বাদু। আমি প্রায়ই এখানে খেতে আসি। আমার মুখে জগন্নাথ ভোজনালয়ের খাবারের কথা শুনে আমার বন্ধু অনেক দিন ধরেই নিয়ে আসতে বলছিল। আজ তাকে নিয়ে এলাম।

নারায়ণগঞ্জ থেকে ইসলামপুরে আসে কাপড় ব্যবসায়ী অনিমেষ রায় নিয়মিত দুপুরে খেতে যান এই ভোজনালয়ে। তিনি জানান, এখানে যে যে ধরনের নিরামিষ আইটেম পাওয়া যায় তা আশপাশে আর কোথাও পাওয়া যায় না। আর এখানকার খাবারের স্বাদও অনন্য।

হোটেলের অন্যতম কর্মচারী সঞ্জয় ১০ বছর ধরে লেখাপড়ার পাশাপাশি এখানে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, শীতকালে বেচাকেনা বেশি হয়, এখন বেচাকেনা একটু কম। হিন্দু মুসলমান সবাই এখানে খেতে আসেন। আমরাও কম দামে ভালো খাবার দেওয়ার চেষ্টা করি।

জগন্নাথ ভোজনালয়ের এই কর্মচারী আরো বলেন, নিতাই বাবুর মৃত্যুর পর মালিকানা বদল হলেও নিতাইবাবুর তৈরি করা নিয়মেই এখনো সব চলছে।

তাঁতিবাজারের এই হোটেলটির যাত্রা ১৬ বছর আগে নিতাইপালের হাত ধরে। সবাই তাকে নিতাইবাবু বলেই ডাকত। করোনায় মৃত্যুর পর হোটেলের মালিকানা হাত বদলায়। বর্তমানে এটির তত্ত্বাবধানে আছে অশোক কবিরাজ।

ভোজনালয়টির মালিক অশোক কবিরাজ বলেন, আমাদের এখানে হিন্দু, মুসলমান থেকে শুরু করে সব ধরনের কাস্টমারই আসেন। স্থানীয় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা সকাল-দুপুরের খাবার খেতে আসেন। কেউ কেউ রাতের খাবারও খান। কেনাকাটা করতে আসা মানুষজনও নিরামিষ খেতে ভালোবাসেন। সেজন্য এখন ভিড়টাও একটু বেশি।

তিনি আরো বলেন, এখানে খাবার সাশ্রয়ী। নিরামিষ খাবার স্বাস্থ্যকরও। যে কেউ নিশ্চিন্তে আসতে পারেন, খেতে পারেন। খরচ বেশি পড়ে না। তাই খাবারের বাড়তি দামও রাখার প্রয়োজন হয় না। অনেকেই খেয়ে আবার পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য পার্সেল নিয়ে যান।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ই-ট্রেড লাইসেন্সপ্রাপ্ত জগন্নাথ ভোজনালয়ের মালিক শিল্পী রানী বলেন, আমাদের হোটেলে কোনো ধরনের আমিষজাতীয় খাবার পাওয়া যায় না, সব নিরামিষ। কোনো ধরনের বাসি খাবার নেই, প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন বিক্রি করা হয়। আজ ১৩-১৪ বছর হলো আমাদের হোটেল, তবুও আমাদের কোনো ফ্রিজ নেই। আমরা ফুডপান্ডা এপেও খাবারের অর্ডার নিই। আমাদের হোটেলটি ছোট পরিসরে হলেও এখানে আশপাশে বড় জায়গা পেলে ভবিষ্যতে আমরা সেখানে আমাদের জগন্নাথ ভোজনালয়টি করব।

রান্নার বিশেষত্ব নিয়ে জানতে চাইলে শিল্পী রানী বলেন, দৈনিক ১৬-১৭ পদের নিরামিষ রান্না হয় এখানে। একাদশীর দিন ছাড়া অন্যদিনে এখানে মিলবে সয়াবিন রসা, বড়া, কাঁচকলার রসা, শুক্ত, সজনে তরকারি, কলার মোচার তরকারি, কাঁঠালের ঋতুতে কাঁঠাল তরকারি, বুট, মাসকলাই ও মুগ ডাল, লাউয়ের তরকারি ও বেগুনি। একাদশীর দিনে পাওয়া যাবে পুষ্পান্ন, খিচুড়ি, ছানার রসা, বাদাম ভুনা, ফুলকপির রসা, সাগুদানা ভুনা ও পাঁচ তরকারি। মিষ্টান্ন হলো শ্যামা দানার পায়েস। একাদশীর দিন ছাড়া অন্যান্য দিনেও এ পদগুলো মিলবে। এই দিনের পদগুলোর সঙ্গে অন্যদিনের পদগুলোর পার্থক্য হচ্ছে মসলা ও তেলে। এ দিনে মসলা বলতে শুধু আদা ও কাঁচা মরিচ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সয়াবিন তেলের বদলে ব্যবহার করা হয় সূর্যমুখীর তেল। সাধারণ দিনে সয়াবিন তেল ও সাধারণ মসলাদি দিয়েই রান্না করা হয়। তবে পেঁয়াজ ও রসুনের ব্যবহার হয় না কোনো দিনই। হয় না মাছ, মাংস ও ডিমের কোনো পদ।

জগন্নাথ ভোজনালয়ে নিরামিষভোজীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। শুধু ধর্মীয় দিকে নয়, এখন অনেকেই শারীরিক সুস্থতার কথা ভেবে নিরামিষ খাবার পছন্দ করছেন। ডাক্তাররা তেলঝোল, চর্বিজাতীয় খাবার সীমিত খেতে বলেন। নিরামিষের পরামর্শ দেন। এতে রোগবালাই কম হয়, স্নায়ু সতেজ থাকে, অতিরিক্ত মেদ জমে না শরীরে, ত্বক ও চুলের ক্ষতি কমে। স্বাস্থ্যসচেতনতা তরুণরাও এখানে নিয়মিত খেতে আসেন বলেও জানান এখানকার কর্মচারীরা। এই তেল-চর্বির ভিড়ে একটু ভিন্নধর্মী স্বাদ পেতে অনেকেই আসেন জগন্নাথ ভোজনালয়ে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close