রাকিব রিফাত

  ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ক্যাম্পাস থেকে ১২০ কিমি সাইক্লিং, নতুন অভিজ্ঞতার ঝুলি

বন্ধুত্বের সম্পর্কগুলো সব সময় ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। খুনসুটির মুহূর্ত, দেশের নির্মল প্রকৃতির উপাখ্যান, প্রেমের মহাকাব্য, দেশের চিন্তা, রাজনৈতিক গল্প, বৈশ্বিক পরিস্থিতিসহ নানা শিরোনামে একেকজনের প্রতিভা ফুটে ওঠে। সময়-সুযোগ পেলে এমন সাহিত্য রসের আসর মাঝেমধ্যেই জমে ওঠে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নিলেও অনেক সময় নানা প্রতিবন্ধকতায় তা ভেস্তে যায়। তবে এবারের গল্পটি ভিন্ন।

বলছিলাম কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ৩০ আগস্ট রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়না চত্বরে বসে গল্প করছিলাম তানভীর মণ্ডল, আল-আমিন আর আমি। এমন সময় দিনব্যাপী সাইকেল ট্যুরের বিষয়টি উঠে আসে। দীর্ঘদিন থেকে এ নিয়ে ভাবলেও কখনো এই ট্যুরটি হয়ে ওঠেনি। এবার নাছোড়বান্দা ওরা দুজন। যেকোনো মূল্যে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। এমন সময় আনাস এসে হাজির, ট্যুরে কথা বলতেই রাজি হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত হলো আগামীকাল সকালেই বের হচ্ছি। উদ্দেশ্য কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার ইউটিউব ভিলেজ, পদ্মাপাড়, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়িসহ গ্রামীণ প্রকৃতির নান্দনিকতা কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখা, যা ক্যাম্পাস থেকে ৪০ ও ৫৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তখনই তানভীর টুক করে ইমনকে ফোন দিল, আর আমি সৌরভকে ফোন দিলাম। ইমন সম্মতি প্রকাশ করলেও, সৌরভ অসুস্থ থাকায় মত পোষণ করল না। ওই সময় তার সঙ্গে থাকা বন্ধু মুরসালিন সাইক্লিংয়ের কথা শুনে আগ্রহ প্রকাশ করলে সৌরভ তাকে সঙ্গে নিতে বলে। দেখতে দেখতে সাইক্লিংয়ের পুরো প্লান সাজানো শেষ। সবাই যার যার মতো করে সাইকেলের ব্যবস্থা করল এবং দ্রুত রুমে ফিরে এলো। একটি বিষয় ভুলে গিয়েছিলাম আমরা সবাই ইবির ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়নরত। সম্পর্কটি সবাই একে অন্যের বন্ধু। যাই হোক, পরের দিনটি ছিল ৩১ আগস্ট। ঘুম ভাঙতেই আল-আমিনের ফোন। এই উটিসনি একনো? (ঝিনাইদহের আঞ্চলিক ভাষা) তোরা কখন বের হবেন? সময় তো গড়িয়ে এলো!

তখনো ঘুমের ঘোরে বুঝে উঠতে পারিনি তার কথা! ঘুম থেকে উঠে বেডে বসে চিন্তাভাবনা করলাম! কি থেকে কি ভাবতেই দিনব্যাপী সাইক্লিং ট্যুরের কথা মনে পড়ে গেল। সাত-পাঁচ না ভেবেই দ্রুত ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

রুম থেকে বের হয়েই একে অন্যকে ফোন দেওয়া শুরু হলো। সাইক্লিংয়ে অংশগ্রহণ করবে ছয়জন বন্ধু। এর মধ্যে পাঁচজনই হলে থাকেন। ইমন ক্যাম্পাসের পাশে বাসা হওয়ায় ও বাসা থেকেই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে এসে উপস্থিত, তখন সময় সকাল ৬টা। সময়ক্ষেপণ না করে বেরিয়ে পড়লাম দিনব্যাপী সাইক্লিংয়ে। যদিও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়টি কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ দুই জেলার সীমান্তঘেঁষে অবস্থিত। উদ্দেশ্য কুষ্টিয়া হলেও যাত্রাটা শুরু হলো ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার মধ্য দিয়ে। সকালের স্নিগ্ধ শিশিরের ছোঁয়া, হালকা মৃদু বাতাসের আঘাতের চলছে সাইক্লিং। হঠাৎ তমালতলা গ্রামে আসতেই বন্ধু আবু হাসানের সঙ্গে দেখা, কুশলবিনিময় শেষে আবারও নাম না জানা গ্রামের মধ্য দিয়ে ছুটে চলছি।

বাতাসের কোমল স্পর্শে হৃদয় আন্দোলিত হচ্ছে। সবার চোখে মুখে হাসি, আড্ডা, গল্প ও গানের তালে তালে গ্রামের পর গ্রাম, মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছি। ছোট ছোট নদী ও ক্যানালের তীরঘেঁষে চলছে সাইক্লিংয়ের প্যাডেল। এ সময় দেশের সোনালি সম্পদ পাট ধোয়ার কাজ করছে গ্রামের সোনার মানুষগুলো। পাটের মুহুর্মুহু ঘ্রাণে এক অন্য রকম অনুভূতি জাগ্রত হয়েছে। সোনার মানুষগুলো সকালের খাবার খাচ্ছে, তাদের এমন দৃশ্যে সবাই সবার অনুভূতি ব্যক্ত করে চলছে। পেরিয়েছি কত আঁকাবাঁকা রাস্তা, দেখেছি কত সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, পুরোনো আমলের নির্মিত বাড়ি, গ্রামীণ মানুষের আচার-ব্যবহার। রাস্তার সঠিক ব্যবহারের জন্য কত মানুষকে বিরক্ত করেছি! এমন সময় কখন যেন ঝিনাইদহ থেকে কুষ্টিয়ার মাঝে এসে পড়লাম। মাঠ-ঘাট পেরিয়ে হঠাৎ গড়াই নদীর তীরে এসে পড়লাম। নদী পার হলেই দেখি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলা। এমন সময় তীব্র গরমে ক্লান্তি দূর করতে বেশি করে লেবু কিনে নিলাম।

ততক্ষণে বেজে গেছে সকাল ৯টা। ক্ষুধার্ত পেট যেন সময়ে সময়ে দুর্বল করে দিচ্ছে। খোকসা বাজারের ভেতরে প্রবেশ করতেই ক্ষুধা যেন বেড়ে গেল। সেরে নিলাম সকালের নাশতা। সকালের খাবার গ্রহণ শেষে আবারও কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী মহাসড়ক দিয়ে চলছি ইউটিউব ভিলেজের দিকে। চলতে চলতে সেই কাঙ্ক্ষিত স্থান ইউটিউব ভিলেজে এসে পড়লাম। তখন সময় সকাল সাড়ে ৯টা।

এটি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। গ্রামটির আসল নাম শিমুলিয়া হলেও ২০১৬ সালের পর এরই নাম হয়ে গেছে ইউটিউব ভিলেজ। ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে এই গ্রামের সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামের সৌন্দর্যবর্ধন এবং বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ইউটিউব পার্ক। এই পার্কের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে বাঁশ-কাঠ আর খড়ের অবকাঠামো এবং ছায়া-সুনিবিড় পরিবেশ ভ্রমণপ্রিয় মানুষের মন ভুলিয়ে দেবে।

খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে মুহূর্তগুলো স্থির চিত্র ধারণ করে, ছুটে চললাম কুমারখালীর শিলাইদহের পদ্মা পাড়ের দিকে। যদিও ইমনসহ কিছু বন্ধুর মত ছিল না! তবুও তাদের বুঝিয়ে ছুটলাম সেখানে। এমন সময় সবাই সবার শক্তি ও মনোবল হারিয়ে ফেলেছিল। শরীরে ক্লান্তি ও অবসাদ এসেছিল। পুরো রাস্তা লেবু ও পানির ওপর নির্ভর করে ছিলাম। রাস্তায় ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম ও প্রাচীন তাঁতশিল্পের কারুকাজগুলো দেখে নেওয়ার সুযোগ হলো এবং তাদের সঙ্গে এ তাঁতশিল্প সম্পর্কে কথা হলে তাদের অনাগ্রহের বিষয়টি ফোটে। তাদের দাবি, এ দিয়ে তাদের পেট চলে না! দুঃখমাখা গল্পগুলো শুনে হজম করে নিলাম। দেশের পথে-প্রান্তরে দুঃখের বীণা সুরের কোলাহল দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সাধ আছে সাধ্য নেই, অন্তরের ঢেকুরে অন্তরেই রেখে দিই সেই করুণ চিত্ত বিনোদন! মাঠ-ঘাট ক্যানালের পাশ দিয়ে চলছি। এমন সময় হঠাৎ করে মাঝগ্রাম নামক স্থানে আসলে কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে বসল আনাস। শিলাইদহ বাজারে এসে তার প্রাথমিক চিকিৎসা করা হলো, এ সময়টায় তানভীর মণ্ডল আনাসের সঙ্গেই ছিল। বাকিরা সব ক্লান্ত দেহে এলিয়ে পড়েছিল। নাম না জানা বিভিন্ন গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গ্রামীণ জনপদে তিন ঘণ্টার সাইক্লিং শেষে পদ্মাপাড়ে এসে গেলাম। এই তিন ঘণ্টার জার্নি আমাদের একেকজনকে ঘামিয়ে তুলেছিল। সবাই এতটাই ক্লান্ত ছিল যে শরীরে সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। পদ্মাপাড়ে এসেই ক্লান্ত দেহ নিয়ে স্নান করতে নেমে পড়ল। ততক্ষণে সবারই শরীরের অনেকাংশে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। স্নান করার মুহূর্তটি প্রশান্তি এনে দিয়েছে। সেখানে কিছু মুরব্বির সঙ্গে পরিচয় ঘটে, তারাও ট্যুরে এসেছে কুষ্টিয়ার পান্টি থেকে। এ ছাড়া স্থানীয় জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্যটি খুবই উপভোগ্য ছিল। পদ্মাপাড়ে সময় কাটানো শেষে দেশের জনপ্রিয় স্থান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি দেখার সৌভাগ্য হলো। তখন সময় দুপুর ২টা গড়িয়েছে। ক্ষুধায় সবার পেট চৌচির! পদ্মাপাড়ের একসঙ্গে স্নান করা মুরব্বিদের কল্যাণে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা হলো। তারা তাদের আগ্রহ থেকেই আমাদের আপ্যায়ন করালেন, যেখানে ছিল খাসির মাংসের খিচুড়ি। খাবার শেষ হতেই কুটিবাড়ি দেখতে বের হলাম। এখানে সব সময় হাজারো দর্শনার্থীর ভিড় লেগেই থাকে। এই কুঠিতে আসলে কবিপ্রেম মনে জাগ্রত হয়ে ওঠে। তার অনবদ্য রচনা ও কর্মগুলো আমাদের বিমোহিত করতে বাধ্য করে। কুঠিবাড়ির পুকুর পাড়ে বিকেলের শান্ত-স্নিগ্ধ বাতাসের সঙ্গে সময় কাটানো হলো। পরে পুরো বাড়ি পরিদর্শন করে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে বের হলাম। কুঠিবাড়ি থেকে আলাউদ্দিন নগরে এসে খাবারের নতুন স্বাদ গ্রহণ ও সাইকেলের যাবতীয় সমস্যা সমাধান শেষে আবার সাইক্লিং শুরু বিশ্বরোডের পথ ধরে। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে বিকেলের হিমেল পরশ সব অবসাদ শুষে নেয়। এমন সময় সৈয়দ মাসুদ রুমী সেতুতে (গড়াই ব্রিজ) এসে স্থির চিত্র ধারণ। পরে কুষ্টিয়া শহরের লাহিনী বটতলার রোড ধরে কমলাপুর, গোপালপুর, পিয়ারপুর, দূর্বাছড়াসহ নাম না জানা গ্রামের মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসের কাছে হরিনারায়ণপুর চলে আসি। এখানেই বাধে বিপত্তি। হঠাৎ ইমনের সাইকেলের চাকা লিক হয়ে যায়। লিক সাড়ার পর ইমন তার বাড়ির দিকে চলতে থাকে। বাকিরা মধুপুর হয়ে চাঁদরাতের মহিমা দেখতে দেখতে ক্যাম্পাসে এসে পড়ি। সারা দিনের ১২০ কিলোমিটারের এই দীর্ঘ যাত্রার সমাপ্তি ঘটে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close