নতুন ফ্রিল্যান্সারদের জন্য গাইডলাইন
ফ্রিল্যান্সিং বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পেশা। ঘরে বসে অল্প সময়ে অধিক আয় করা যায়। আছে কাজের স্বাধীনতাও। আহামরি শিক্ষাগত যোগ্যতারও প্রয়োজন হয় না। ইংরেজি এবং যে কাজ করবেন শুধু সেগুলোর ওপর দক্ষতা থাকা চাই। তবে সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। নতুন যারা ফ্রিল্যান্সিং শিখতে চাচ্ছেন। তারা নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। সঠিক গাইডলাইনের অভাবে পথ হারাচ্ছেন অনেকে। শুরুতেই হচ্ছেন আশাহত। নিজে যেমন ফ্রিল্যান্সিং করে লাখ টাকা আয় করছেন। তেমনি অসংখ্য মানুষকে শিখিয়েছেন ফ্রিল্যান্সিং। দিয়েছেন প্রতিষ্ঠান। এ রকম কয়েকজন ফ্রিল্যান্সার নতুনদের জন্য তাদের পরামর্শ দিয়েছেন। লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
এ এইচ আলী
গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ফ্রিল্যান্সিং করছেন এ এইচ আলী। নিনজাস আইটি, ইউটিউব এক্সপার্টস নামে দুটি ভার্চুয়াল প্রতিষ্ঠান আছে তার। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে ছয়জন লোক কাজ করে। ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে আলীর কাজকর্ম। তিনি বিভিন্ন ট্রেন্ডিং টপিকের ওপর ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার নিয়ে কাজ করেন। অনেক ট্রাফিক, সাবস্ক্রাইব বা পেজ ফলোয়ার এনে সেগুলো পেজ বিক্রি করে দেন। কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন ইয়ুথ রাইজিং অ্যাওয়ার্ড। মাসে আলীর আয় দুই লাখ টাকারও বেশি। ফ্রিল্যান্সিংয়ে এ পর্যন্ত তার আয় প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি। আলী কুষ্টিয়ায় বসে ফ্রিল্যান্সিং করেন। নতুনদের জন্য তার পরামর্শ- যে সেক্টর যে কাজের ডিমান্ড আছে সেই কাজ শিখে সেটাই পেশা হিসেবে বেছে নিন। কাজের দক্ষতা অর্জন আগে পরে আয়ের কথা ভাবতে হবে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হওয়ার কোনো শর্টকাট লাইন নেই। অবশ্যই সাফল্য পেতে বা ভালো করতে হলে কাজ শিখতে হবে এবং সেই কাজে দক্ষ হতে হবে। মনে রাখবেন, কাজ শেখা আর দক্ষ হওয়া এক না। আপনি ইন্টারন্যাশনালি ফাইট করে অনলাইনে একটা কাজ নিচ্ছেন। তাই অবশ্যই সেই কাজে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারলে আপনার সামনের পথ সুগম হবে, না হলে ঝরে যাবেন। ফ্রিল্যান্সিং করতে গেলে আমাদের বেশির ভাগ ইংরেজিতে কথা বা মেসেজিং করতে হয়। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিকস বা ডিজিটাল মার্কেটিং যেটাই শিখুন না কেন। এসব এর পাশাপাশি ইংরেজিটা ভালো করে শিখতে হবে, যা কাজ পেতে সাহায্য করবে। কমিউনিকিশন স্কিল ডেভলপ করতে হবে।
মিনহাজুল আসিফ
কোডম্যানবিডি এবং ওয়েব ব্যাটেলিয়ন এজেন্সির প্রতিষ্ঠাতা। এ দুটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে অর্ধশতাধিক মানুষ। আসিফ এক হাজারেরও বেশি প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। দশ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী তার প্রতিষ্ঠানে ফ্রিল্যান্সিং শিখে খুঁজে পেয়েছে আয়ের পথ। আপওয়ার্ক মার্কেটপ্লেসে এ টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার এবং ফাইভার এ লেভেল ২ সেলার তিনি। এ পর্যন্ত শুধু ফ্রিল্যান্সিং করে ১,৫০,০০০ ডলার আয় করেছেন। তিনি ২০২৩ সালে ‘যুব উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে অসাধারণ অবদান’ এর জন্য ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড’, ‘যুব উন্নয়ন অ্যাওয়ার্ড’, ‘লার্ন অ্যান্ড আর্ন বেস্ট মেন্টর’, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যারিয়ার অ্যাওয়ার্ড’, ‘বেস্ট এড-টেক উদ্যোক্তা’, ‘বিজনেস ডাইজেস্ট সাইনিং পার্সোনালিটি অ্যাওয়ার্ড’সহ অনেক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। নতুনদের জন্য তার পরামর্শ হলো- প্রথমেই দেখতে হবে, যেখানে শিখতে চাচ্ছেন। যে বা যারা ফ্রিল্যান্সিং শেখাচ্ছেন। ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর এবং মার্কেটপ্লেসে তারা দক্ষ কি না। কোর্সের মান যাচাই করতে হবে। এজন্য আগের স্টুডেন্টদের ফিডব্যাক নেওয়া ভালো। বর্তমানে প্রতিটি সেক্টর যেমন ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, সাইবার সিকিউরিটির ওপর অসংখ্য ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপে গিয়ে জানতে চাইতে পারেন তাদের সম্পর্কে। এতে করে ওই প্রতিষ্ঠানের বিষয় বর্তমান এবং পূর্ববর্তী স্টুডেন্টদের ফিডব্যাক পাওয়া যেতে পারে। অবশ্যই ভালো কোনো ইনস্টিটিউট থেকে স্কিল ডেভেলপমেন্ট করতে হবে, যেখানে শুধু কোর্স করিয়ে সব শেষ হয় না। বরং সময়ে-অসময়ে পর্যাপ্ত সাপোর্ট প্রদান করে। পাশে থাকে সহযোগিতার মাধ্যমে।
সুদীপ্ত কুমার মণ্ডল (অপু)
আপওয়ার্ক হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস। প্রায় এক কোটির বেশি ফ্রিল্যান্সার আপওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত। কিছুদিন আগে আপওয়ার্ক তার অফিশিয়াল ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ, ইনস্টাগ্রাম এবং লিংকড ইন আইডি থেকে বাংলাদেশি এক ফ্রিল্যান্সারকে আপওয়ার্ক স্পর্টলাইট হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশি এই ফ্রিল্যান্সারের নাম সুদীপ্ত কুমার মণ্ডল (অপু)। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নাইজেরিয়া, ইতালি, ইন্ডিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের ক্লায়ান্টদের পাঁচশোরও বেশি প্রজেক্ট তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। শেষ তিন বছরে তার আয় ৩০ হাজার ডলারেরও বেশি। মাসে তার গড় আয় দুই লাখ টাকার মতো। নতুনদের জন্য অপুর পরামর্শ হলো, আগে উপার্জনের কথা না ভেবে ভালোভাবে কর্মদক্ষতা অর্জন করতে হবে। স্কিল এবং কমিউনিকিশন ভালো হতেই হবে। পাশাপাশি বেছে নিতে হবে বৈধ্য কাজগুলো। কাজের বেলায় সততা বজায় রাখতে হবে।
সাদী রহমান
হওয়ার কথা ছিল তার আইনজীবী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করলেও মাস্টার্স করা হয়নি। অর্থনীতির টানাপড়েনের কারণে তাকে খুঁজতে হয় আয়ের পথ। স্থায়ীভাবে এখন তিনি কাজ করেন বিদেশি দুটি কোম্পানির। নিজেও খুলেছেন একটি এজেন্সি। মাসে তার আয় চার থেকে ছয় হাজার ডলার। জীবনযুদ্বে সফল এই ফ্রিল্যান্সারের নাম সাদী রহমান। ইউটিউব, ফেসবুকে অমুক কোর্স করলেই লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। এমন চকলাদার বিজ্ঞাপনের বিষয়ে তিনি নতুনদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি নতুনদের জন্য ধৈর্য, এডুকেশন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করার ওপর গুরুত্ব দেন।
শাওন মীর
প্রতি ঘণ্টায় তার সর্বোচ্চ আয় ৯৯৯ ডলার। মাসে গড় আয় তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা। ২০২০ সালে আগস্ট মাসে তার ফ্রিল্যান্সিং শুরু। ২ বছর ২ মাসে তিনি ফ্রিল্যান্সিং করে আয় করেছেন ১ লাখ ডলারেও বেশি। তিনি একজন ইথিক্যাল হ্যাকার এবং পেনেট্রেশন টেস্টার। তিনি মূলত বিভিন্ন ওয়েব সার্ভারের বা এপ্লিকেশনের দুর্বলতা খুঁজে বের করেন। সমাধানের পথ বাতলে দেন। নতুন ফ্রিল্যান্সাররা অনেক সময় অনেক সময় কাজ পান। অথচ চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে শাওন বলেন, প্রোফাইল ঠিকভাবে গোছানো নেই হয়তো, কারণ প্রথম ইম্প্রেশনে ভালো না লাগলে কাজ দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাদের জব প্রপোজাল ঠিকভাবে লেখা হয়নি। কপি পেস্ট অথবা অসম্পূর্ণ কভার লেটার লিখে। কভার লেটারের সঙ্গে কাজের স্যাম্পল নেই। ইন্টারভিউর সময় ক্লায়েন্টকে কনভেন্স করতে না পারা। এসবই তার কাজ না পাওয়ার কারণ হতে পারে।
মেহেদী হাসান শুভ
তিনি নিজে ফ্রিল্যান্সিং করার পাশাপাশি প্রায় তিন হাজার মানুষকে একদম বিনে পয়সায় ফ্রিল্যান্সিং শিখিয়েছেন। মাসে তার আয় পনেরো শ থেকে দুই হাজার ডলার। কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন রাইজিং ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড, গ্লোবাল চেঞ্জমেকার্স অ্যাওয়ার্ড, মহাত্মা গান্ধী অ্যাওয়ার্ড। তিনি সরকারের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টের একজন প্রশিক্ষক। অদম্য তরুণ এই ফ্রিল্যান্সারের নাম মেহেদী হাসান শুভ। নতুনদের জন্য তিনি বলেন, আপনি যে কাজটি করতে ভালোবাসেন এমন একটি কাজ পছন্দ করে সে বিষয় শিখে কাজ করতে হবে। শেখার জন্য প্রথম ওপেন সোরস ইউটিউব, গুগল ব্যবহার করা ভালো। কাজে দক্ষ না হয়ে মার্কেটপ্লেসে অ্যাকাউন্ট তৈরি করা উচিত না। ইংরেজিতে দুর্বল থাকলে আগে চর্চা করে নিন অন্তত যাতে বায়ারদের সঙ্গে সুন্দরভাবে যোগাযোগ করতে পারেন। যোগাযোগ দক্ষতা অর্জন খুব জরুরি। যে টপিকগুলো একেবারে সহজ সে বিষয় পছন্দ না করে একটু সময় নিয়ে কাজ করতে হয় এমন বিষয় কাজ শেখা এবং করা উচিত।
"