মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ

  ২১ আগস্ট, ২০২৩

পুরান ঢকার বিখ্যাত ‘টাকি পুরি’

বাহারি খাবার, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার জন্য বরাবরই বিখ্যাত রাজধানীর পুরান ঢাকা। প্রায় ৪০০ বছর ধরে সুস্বাদু নানা পদের খাবারের জন্য এই এলাকার সুনাম রয়েছে। তেমনি এক জনপ্রিয় খাবার ‘টাকি পুরি’। ডাল পুরি, আলু পুরির নাম সবার কাছে পরিচিত হলেও অনেকেই জানে না টাকি মাছের তৈরি এ টাকি পুরির নাম।

রাজধানীর পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকার ১৫/১৪, টিপু সুলতান রোডের খান হোটেলে সুস্বাদু এ টাকি পুরির খুঁজ মিলবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই প্রায় প্রতিদিন এই হোটেলের সামনে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। হোটেলটির সামনে সারি সারি সাজিয়ে রাখা থাকে পুরি, পেঁয়াজু, আলুর চপ, বেগুনি, চিকেন চপ, ছোলা, ডাবলি বুট এবং গরম গরম জিলাপি। কিন্তু সিংহভাগ গ্রাহকের নজর ওই টাকি পুরির দিকে। এখানে পুরি খেতে আসা অনেকেই এসেছেন দূরদূরান্ত থেকে। নিয়মিত-অনিয়মিত অনেকের মুখেই এই পুরির সুনাম ছড়িয়েছে বিস্তর। টাকি পুরির স্বাদই এর প্রধান বিশেষত্ব।

টিপু সুলতান রোডের জোড়পুল বাজারের মুখেই গড়ে ওঠা খান হোটেল বয়স ষাটোর্ধ্ব। হোটেলটির প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল খান অনেক আগেই মারা গেছেন। বর্তমানে হোটেলটির ব্যবসা দেখভাল করছেন তার ছেলে মো. বিল্লাহ খান। বংশ পরমপরায় আগে নানা ধরনের পুরি বিক্রি হলেও টাকি পুরির এই রেসিপি তারই আবিষ্কার। টাকি মাছ দিয়ে পুরি হয় এটা কেউ ভাবতে না পারলেও এমনটিই করে দেখিয়েছেন তিনি। শুনতে নতুন মনে হলেও টাকি পুরির বয়স প্রায় ১৫ বছর।

টাকি পুরির আদ্যোপান্ত জানতে চাইলে বিল্লাল খান জানান, বিক্রির উদ্দেশ্যে নয়, বরং নিজে খাওয়ার জন্যই হুট করে একদিন টাকি পুরি তৈরি করা হয়। বাড়িতে স্ত্রীর বানানো সুস্বাদু টাকি মাছের ভর্তা খেতে খেতে চিন্তা আসে টাকি মাছের পুরির। টাকি পুরির স্বাদে মুগ্ধ হয়েই দোকানে বিক্রির চিন্তা আসে। তখন থেকেই এই পুরির যাত্রা শুরু হয়।

তিনি আরো জানান, টাকি পুরির বিক্রির শুরু হতেই এমন অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। প্রথম দিন থেকেই টাকি পুরি গ্রাহকদের মন জয় করে নিয়েছে। তা ছাড়া রান্নায় যে তেল ব্যবহার করা হয় তা একদম পিওর। একদিনের তেল আরেক দিন ব্যবহার করা হয় না বলে স্বাদটা হয় ভিন্ন। এখন তো দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ এই টাকি পুরির স্বাদ নিতে ছুটে আসছে।

১০ বছর ধরে দোকানটিতে কাজ করছেন মোহাম্মদ হানিফ। রেসিপি প্রসঙ্গে তিনি জানান, সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে টাকি পুরির জন্য যেসব টাকি মাছ সংগ্রহ করা হয় সেগুলোর কাঁটা সূক্ষ্ম ও সুনিপুণভাবে আলাদা করা হয়। পরে কাঁটা ছাড়িয়ে টাকি মাছ সেদ্ধ করে তেলে ভেজে নেওয়া হয়। এরপর কাঁচা মরিচ, সেদ্ধ আলু, ধনেপাতা, পেঁয়াজ ও স্পেশাল মসলা মিশিয়ে বানানো হয় কিমা। ময়দার মধ্যে কিমা গুঁজে দিয়ে তেলে ভাজা হয় এই টাকি পুরি। ভাজার পর তেল ছেঁকে আলাদা হওয়ার পর পরিবেশন করা হয় টাকি পুরি।

তিনি আরো জানান, শীতে টাকি মাছ সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় বলে এ সময় পুরিতে মাছের পুরের পরিমাণও বেশি থাকে। শীতকালে নতুন কাঁচামরিচ, ধনেপাতা, কাঁচা পেঁয়াজ ইত্যাদির সংমিশ্রণে পুরির স্বাদ বেড়ে যায় বহু গুণ।

এই পুরির সঙ্গে খাবারের জন্য দেওয়া হয় বিশেষ এক ধরনের চাটনি। চাটনি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় টকদই, সরিষাবাটা, ধনেপাতা ও কাঁচামরিচ। চাইলে সঙ্গে নিতে পারবেন টমেটো সস। প্রতিটি টাকি পুরির দাম ১০ টাকা। আকারেও বেশ বড়। প্রতিদিন প্রায় হাজারের অধিক টাকি পুরি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান হোটেলের কর্মচারীরা। হোটেলটিতে বর্তমানে প্রায় ৭০ জন কর্মচারী রয়েছেন।

হোটেলটিতে টাকি পুরির পাশাপাশি চিকেন পুরি, ডাল পুরি, আলু পুরি, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপসহ অনেক ধরনের খাবার পাওয়া যায়। এ ছাড়া এখানে চিকেন চাপ, ছোলা বোট, ভুঘনি এবং জিলাপিও পাওয়া যায়।

ওয়ারী এলাকার বাসিন্দা সোহান শেখ পুরি খেতে খেতে বলেন, এখানকার টাকি পুরিগুলো খেতে খুবই মজা। প্রায় সময় বিকেলে এখানে পুরি খেতে আসা হয়। গরম গরম পাওয়া যায়। তাই ফুঁ দিয়ে দিয়ে খেতে হয়।

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বংশাল থেকে টিপু সুলতান রোডে এসেছেন টাকি পুরি খেতে। তিনি বলেন, এই পুরি খেতে অনেক সুস্বাদু। খুব মজার একটা খাবার এটা। বিকেলের নাশতায় আমার খুব প্রিয়। ১০ টাকার এই পুরি একটা পেট ভরে যায়। মাঝে মাঝে প্রতি সপ্তাহেই এখানে আসা হয়। এটি পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারও বটে।

সূত্রাপুর থেকে বন্ধুদের নিয়ে টাকি পুরি খেতে এসেছেন লামিম আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা নিয়মিত এখানে আসি। ১০ টাকায় অনেক মজার পুরি পাওয়া যায়। আমরা বন্ধু-বান্ধবরা সবাই বলি, পুরির রাজা টাকি পুরি।

রাজশাহী থেকে টাকি পুরি খেতে এসেছেন মো. ওয়াসিম রেজা। তিনি বলেন, অনেক আগে থেকেই এই পুরির নাম শুনেছি। কিন্তু আজ এসেছি, পুরিও খাচ্ছি। এখানে অনেক ভিড়। পুরি খেতে খুব ভালো লাগছে।

বিল্লাহ বলেন, আমার ব্যবসায় লাভ খুব সামান্য। অনেকেই পরিমাণে কম দিয়ে লাভ বেশি করে- বিষয়টি আমার ভালো লাগে না। হাতের নাগালের মধ্যে আমার এখানে সব পাওয়া যায় বলে ক্রেতার ভিড় লেগেই থাকে।

হোটেলের সামনে মুদি দোকানদারি করেন সুজন মিয়া। তিনি টাকি পুরি খাওয়াটা প্রায় নিয়মই বানিয়ে ফেলেছেন। চোখের সামনে ভাজে তা তিনি না খেয়ে থাকতেই পারেন না বলে জানান।

আট বছর ধরে দোকানটিতে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন শওকত ওসমান। ক্রেতার ভিড়ের মাঝেও তিনি জানালেন, পুরান ঢাকায় একমাত্র খান হোটেলেই পাওয়া যাবে বিখ্যাত এ টাকি পুরি। বৃষ্টি ও শীতের সময় টাকি পুরির চাহিদা দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। সাধারণত দিনে হাজার থেকে ১২০০ টাকি পুরি বিক্রি হয়। শীতের সময় ১৫০০ থেকে ১৬০০ পুরি বিক্রি হয়ে থাকে। বিকেল ৪টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত টাকি পুড়ি পাওয়া যায়।

তিনি আরো জানান, দোকানে এসে অনেকে টাকি পুরি খায়, কেউবা পার্সেল নিয়ে যায়, এমনকি পাঠাওফুড, ফুডপান্ডা এবং হাঙ্গরিনাকি ডটকমে সহজে অর্ডার করেও খান হোটেলের টাকি পুরি নেওয়া যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close