তানিউল করিম জীম

  ০৭ আগস্ট, ২০২৩

এফএও ট্যাংক আইস বক্স

মাছের আহরোণত্তর ক্ষতি কমাবে

সাধারণত খাবারের উপাদানের সহজলভ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে কোনো একটি অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস। অবিভক্ত বাংলায় পলিমাটির গুণ, নদী-নালা আর বৃষ্টির আশীর্বাদে পুষ্ট ছিল বাঙালি। আর কিছু না পেলেও দুবেলা মাছ-ভাত কোনোমতো জুটেই যেত। সেই থেকেই বাঙালি হয়ে এসেছে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। তবে সময়ের পরিক্রমায় পরিবর্তন হয়েছে বাঙালির জীবনযাত্রা। মাছে-ভাতে বাঙালি এখন শুধু নামমাত্র। ঠিকমতো যত্নের অভাবে নষ্ট হয় অনেক মাছ। বাজারে আসতে আসতে পচন ধরে সিংহভাগ মাছে। মাছের পুষ্টিগুণ বজায় রাখতে ও অপচয় কমাতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ফিশারিজ টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম নওশাদ আলম নকশা করেছেন এফএও ট্যাংক আইস বক্স। দেশে বক্সটি ব্যবহারে মাছের আহরোণত্তর ক্ষতি কমেছে প্রায় ১৮ ভাগ। আগে যেখানে মাছের আহরোণত্তর ক্ষতি ছিল ৩০ ভাগের কাছাকাছি, এখন এই বক্স ব্যবহারে তা কমিয়ে ১২ ভাগে এসেছে। এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে ক্ষতির পরিমাণ আরো কমবে বলে মনে করেন গবেষকরা। এই প্রযুক্তি দেশ ছাড়িয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। এফএও ট্যাংক আইস বক্স হচ্ছে স্থানীয়ভাবে তৈরি চমৎকারভাবে নকশা করা একটি কার্যকর বরফ বক্স, যার মাধ্যমে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে অনেক পরিমাণ মাছ একসঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে গুণগতমান অক্ষুণ্ন রেখে পরিবহন করা হয়। আমাদের দেশে মাছের অন্যতম উৎস হলো নদী এবং সমুদ্র থেকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ধরা মাছ। মাছ ধরার ওইসব ছোট মাঝারি বা বড় নৌকাগুলোতে প্রাথমিকভাবে সংরক্ষণ করা হয় মাছ। মাছ ধরার ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যেই মাছে পচন ধরতে শুরু করে। তাই মাছ ধরার পরপরই আইস বক্স ব্যবহার করলে মাছের গুণাগুণ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভালো থাকবে। ২০০০-০৫ সালে কক্সবাজারে মৎস্য বিভাগ এবং জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) পরিচালিত ইসিএফসি প্রকল্পের (বিজিডি/৯৭/০১৭) সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ড. এ কে এম নওশাদ আলমের উদ্ভাবিত এই বরফ বক্সটি সাধারণত দীর্ঘ দূরত্বে বেশি পরিমাণ মাছ পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষণা ২০০০ সালে শুরু হলেও এটি সম্প্রসারণ করতে সময় প্রায় ২০ বছর সময় লেগেছে বলে জানান গবেষক। গবেষক নওশাদ বক্সটি সম্পর্কে বলেন, বর্তমানে এই এফএও ট্যাংক আইস বক্সটি দেশের অভ্যন্তরীণ মাছ পরিবহনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিআই সিট দিয়ে তৈরি ৩’x ২.৫’x২’ আকারের একটি বক্স চারদিকে লোহার অ্যাঙ্গেল বার ও ফ্লাট বারের ফ্রেমের ভেতর বসিয়ে ট্রাকে পরিবহনের উপযোগী করা হয়েছে। বক্স তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে প্লেইনসিট, অ্যাঙ্গেল, ফ্লাট বার, শিকল, কাছি, কর্কসিট, আংটা, কবজা, রং, রশি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। জিআই সিট দিয়ে মোড়ানো কর্কসিটের বক্সটি শক্ত ও টেকসই করার জন্য এর বাইরের দিকে একটি অ্যাঙ্গেল ও ফ্লাট বারের তৈরি ফ্রেম বসিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ট্রাকে ওঠাণ্ডনামা ও পরিবহনের সময় বরফ বক্স বা বাক্সের ভেতরের মাছ আঘাত না পায় বা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। প্রয়োজনের তাগিদে ও সুবিধামতো বাণিজ্যিক পরিবহনকারীরা ডিজাইনে কিছুটা পরিবর্তন করে নিয়েছেন। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা অঞ্চলে ব্যবহৃত হয় ৩৬x২৪x২০ ইঞ্চি সাইজের বক্স, আবার সাতক্ষীরা অঞ্চলে ৩৮x২৮x২৫ ইঞ্চি, ভৈরব অঞ্চলে ৩৬x২৪x২২ ইঞ্চি বা ২৪x১৮x১৮ ইঞ্চি সাইজের বক্স ব্যবহৃত হচ্ছে। বড় বাক্সে শীতকালে বরফ বাদে ২৫০-২৮০ কেজি এবং গরম কালে ২০০-২২০ কেজি মাছ পরিবহন করা যায়। ছোট বাক্সে শীতকালে ১২০-১৫০ কেজি এবং গরমকালে ৮০-১২০ কেজি মাছ পরিবহন করা হয়। বড় আকারের ভালো মানের ট্যাংক আইস বক্সের দাম ৭,০০০-৮,০০০ টাকা। প্রয়োজন অনুযায়ী এর আকার পরিবর্তন করা যেতে পারে। ট্যাংক আইস বক্স ৮ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত টেকসই হয়। গবেষক আরো জানান, দেশের প্রধান প্রধান অবতরণ কেন্দ্র, আড়ত বা মাছের বাজার থেকে বেশির ভাগ মাছ এভাবে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর বা উত্তরবঙ্গে পরিবহন করা হচ্ছে। ঢাকার কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী বা অন্যান্য মাছের আড়তে গেলে এই চিত্রটি সহজেই অনুধাবন করা যাবে। মাছ সংরক্ষণ ও পরিবহনে ব্যবহৃত এই বরফ বক্সগুলো তৈরির জন্য দেশব্যাপী অসংখ্য ছোট-বড় উদ্যোক্তা ও নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের ভৈরব, ঢাকার রামপুরা, ধোলাইখাল, যাত্রাবাড়ী ও এখন কক্সবাজারের এন্ডারসন রোড, ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জ, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে এসব বরফ বক্স তৈরি হচ্ছে। বহু বেকার লোকজন এতে আয়ের পথ খুঁজে পেয়েছেন। মাছ ব্যবসায়ীরা বড় বাঁশের ঝুড়ি (৫-৬ মণ মাছ পরিবহন করা হয়) ও এফএও ট্যাংক আইস বক্সের মধ্যে মাছ পরিবহনের তুলনামূলক ব্যয় হিসাব করে বের করেছেন। একটি বাঁশের ঝুড়ি মাত্র একবার ব্যবহার করা যায়। একবার মাত্র ব্যবহারে বাঁশের ঝুড়ির জন্য ৮৩০ টাকা ব্যয় হয়। এর বিপরীতে আট বছরে একটি ট্যাংক আইস বক্স প্রায় ৯৬ বারের বেশি ব্যবহৃত হতে পারে এবং প্রতিবারের জন্য মাত্র ৮৬ টাকা খরচ হয়। ট্যাংক আইস বক্স দীর্ঘ পরিবহনেও মাছের উন্নত গুণগতমান বজায় রাখে এবং বরফ পরিবর্তন না করে ১৬-২৪ ঘণ্টা মাছকে সজীব রাখে। তাই মাছের গুণগতমানের অবনতির কারণে মূল্য কমে যাওয়া বা পরিবহনকারীদের লোকসান হওয়া ট্যাংক আইস বক্সের ক্ষেত্রে থাকেই না বরং মুনাফা অনেক বেশি হয়। ট্যাংক আইস বক্সে পরিবহনকৃত মাছ আহরণোত্তর ক্ষতি প্রশমণের পাশাপাশি পরিবহন ব্যয়ও যথেষ্ট পরিমাণ কমিয়ে দেয়, যদিও ট্যাংক আইস বক্সের প্রাথমিক বিনিয়োগ সামান্য বেশি, একটির নির্মাণ খরচ প্রায় ৭,০০০-৮,০০০ টাকা। গবেষক জানান, আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা ছিল যে বরফ দেওয়া মাছ মানেই পচা মাছ। আবার যারা মাছ আহরণ করেন, তাদের কাছে মাছ সব থেকে বেশি সময় থাকে। তারপর আড়তদার, বাজার সর্বশেষ গ্রাহকের কাছে যায়। এত দীর্ঘ সময় পর যখন মাছ গ্রাহকের কাছে যায়, তখন মাছের জৈবিক অবস্থার অবনতি হয়। কিন্তু ওই মাছই যদি ১ম থেকেই বরফে রাখা হয়, তাহলে মাছের জৈবিক অবস্থা ভালো থাকবে। মাছের ভালো দাম পাবেন ব্যবসায়ীরা, অন্যদিকে গ্রাহকরা পাবেন ভালো মাছ। এই বরফ মাছে কেউ ১ম দিকে সহজে ব্যবহার করতে চাইতেন না। এখন তারা অনেকটাই সচেতন হয়েছেন। ২০ বছরের মতো সময় লেগেছে এই প্রযুক্তিটি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close