রূপম চক্রবর্ত্তী
বেল, তুলসী, বাসকের যত উপকার
আমাদের চারপাশে অনেক গাছ আছে, যেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক রোগ নিরাময় করতে পারি। প্রত্যেকটি ভেষজ উদ্ভিদেরই কিছু না কিছু ঔষধি গুণ রয়েছে। ওষুধশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ভেষজ উদ্ভিদের চাহিদা সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বেড়ে চলেছে। আয়ুর্বেদ এবং হোমিওপ্যাথি ওষুধ উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করা হয়। বিউটি পার্লার ও প্রসাধনীতে এখন প্রচুর ভেষজ উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে পরিচিত ঔষধি গুণসমৃদ্ধ উদ্ভিদগুলো হচ্ছে, সোনাপাতা, যষ্টিমধু, বাবলা, শতমূলী, ইসবগুল, আদা, রসুন, হলুদ, পেঁয়াজ, পুদিনা, ঘৃতকুমারী, থানকুনি, নিম, বহেড়া, কালিজিরা, উলটকমল, অশ্বগন্ধা, সর্পগন্ধা, তুলসী, মেথি, বেল, অর্জুন, আমলকী, দুর্বা ইত্যাদি। কয়েকটি ভেষজ উদ্ভিদ যেমন বেল, তুলসী এবং বাসকের ঔষধি গুণাগুণ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
বেল...
ইংরেজিতে বেলকে ডাকা হয় উড আপেল। কারণ এ ফলের খোসা কাঠের মতো শক্ত। বাংলায় ফলটির ব্যাপক কদর দেখে ব্রিটিশরা নাম দিয়েছে বেঙ্গল কুইন বলে। এর বৈজ্ঞানিক নাম : বেল রুটাসি লেবু পরিবারের সদস্য। এর সংস্কৃত নাম বিল্ব। বেলের জন্ম ভারতবর্ষে। বাংলাদেশের সর্বত্র বেল জন্মালেও রাজশাহী ও কুষ্টিয়া জেলায় বেলগাছ বেশি দেখা যায়। রাজশাহী ও গাজীপুরে বড় আকারের ফলের গাছও জন্মায়। শীতকালে বেলগাছের সব পাতা ঝরে যায়, আবার বসন্তে নতুন পাতা আসে। বেল ফল দেখতে সাধারণত গোলাকার শক্ত খোসার। কাঁচা ফলের রং সবুজ, পাকলে বেল হলদে হয়ে যায়। ভেতরের শাঁসের রং হয়ে যায় কমলা বা হলুদ। পাকা বেল থেকে সুগন্ধ বের হয়।
বেলের শাঁসে থাকে জল, আমিষ, স্নেহপদার্থ, শর্করা, ক্যারোটিন, থায়ামিন, রিবোফ্ল্যাবিন, মিনিয়াসিন, এসকর্বিক অ্যাসিড, টারটারিক অ্যাসিড। বেল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ও আমাশয়ে উপকার করে। আধাপাকা সেদ্ধ ফল আমাশয়ে অধিক কার্যকর। বেলের শরবত হজমশক্তি বাড়ায় এবং তা বলবর্ধক। বেলের পাতার রস মধুর সঙ্গে মিশিয়ে পান করলে চোখের ছানি ও জ্বালা উপশম হয়। পাতার রস, মধু ও গোল মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে পান করলে জন্ডিস রোগ নিরাময় হয়। পেট খারাপ, আমাশয়, শিশুর স্মরণ শক্তি বাড়ানোর জন্য বেল উপকারী। বেলে প্রচুর ভিটামিন সি আছে। এই ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বেল নিয়মিত খেলে কোলন ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়।
তুলসী...
তুলসীগাছ বাংলাদেশ এবং ভারতে বৈদিককাল থেকে ফলানো হয়ে আসছে। এটি সাধারণত মন্দিরের আশপাশে রোপণ করা হয় এবং বেশির ভাগ হিন্দু বাড়িতে পাওয়া যায়। তুলসী গাছের মাপ এবং রং ভূগোল, বৃষ্টিপাত এবং গাছের ধরনের ওপর নির্ভর করে। এই তুলসীগাছের বহুবিধ উপকারের জন্য এখন আর হিন্দু বাড়ির মধ্যে এই গাছ সীমাবদ্ধ নাই। স্বাস্থ্যসচেতন ব্যক্তিরা তাদের বাগানে এই মূল্যবান গাছটি রোপণ করছেন। রান্না থেকে ওষুধ পর্যন্ত এর বিস্তৃত ব্যাপ্তি রয়েছে ব্যবহারে। তুলসীর সুগন্ধ এবং তিক্ত স্বাদ সালাদ এবং সসের সঙ্গে খেলে জিভে জল চলে আসে। প্রাচীনকালে তুলসীকে শুদ্ধতার প্রতিক ধরা হতো। বিশ্বাস করা হয় যে তুলসী গাছের সামনে গিয়ে এর ঘ্রাণ নিলেই অনেক ধরনের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। আধ্যাত্মিক মর্যাদার কারণে তুলসীকে পবিত্র তুলসী বলা হয়ে থাকে। আয়ুর্বেদে, তুলসী পরিচিত বিস্তৃত স্বাস্থ্য উপকারিতার প্রদানকারী হিসেবে। তুলসীর জীবাণুবিরোধী, প্রদাহবিরোধী, বাতবিরোধী, কেমোপ্রতিরোধী, যকৃৎ সুরক্ষাকারী, ডায়াবেটিসবিরোধী, হাঁপানিবিরোধী বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
তুলসীগাছ পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহ করে, এ কারণে একে ‘অক্সিজেনের ভাণ্ডার’ বলা হয়। বহু গুণের সমাবেশে এই তুলসীগাছে। তুলসী একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সক্রিয় জৈব যৌগ। এই গুণের কারণে এটি আপনার ত্বক এবং চুলের জন্য দুর্দান্ত। এটি আপনার শরীরকে শুধু অক্সিডেটিভ চাপ এবং ক্ষতি থেকেই রক্ষা করে তা নয়, এটি আপনার ত্বক এবং চুলের বিন্যাস উন্নত করে। উপরন্তু, এটি সরিয়াসিস, কুষ্ঠ, চর্মরোগের মতো বিভিন্ন ত্বকের সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর। এটি একটি জীবাণুবিরোধী প্রতিনিধি এবং এটি ত্বকে আঘাত বা পোকার কামড় নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। চুলের প্রসঙ্গ এলে, তুলসীর ব্যবহারে শুধু চুল পাকা বিলম্বিত হয় বা চুল পড়া কমায় তা নয়, টাক পড়ার হাত থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। সর্দি, কাশি, কৃমি ও বায়ুনাশক এবং মূত্রকর, হজমকারক ও এন্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহৃত হয় তুলসীপাতা। কফের প্রাধান্যে যেসব রোগ সৃষ্টি হয়, সে ক্ষেত্রে তুলসী বেশ ফলদায়ক। মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা কমাতে তুলসী খুবই উপকার। শিশুদের সর্দি-কাশির জন্য তুলসীপাতা মহাষৌধ হলেও যেকোনো বয়সের মানুষই এ থেকে উপকার পেয়ে থাকে।
বাসক...
ছোট থেকে বাসকের সঙ্গে পরিচিত। কাসি হলে মা বাসক পাতার রস খাওয়াতেন। কাসি নিবারণের জন্য বাসক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। বাসক মাঝারি মাপের গাছ। গাঢ় সবুজ রঙের উদ্ভিদ এবং চেহারায় তেমন কোনো বিশেষত্ব নেই। বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বাসকগাছ পাওয়া যায়। বাসকগাছ ঔষধি বাজারে বা নার্সারিতেও পেতে পারেন। তবে এ গাছ দুর্লভ নয়। পাতা ইত্যাদি চেনা থাকলে সহজেই নিজে সংগ্রহ করে নেওয়া সম্ভব। বাসকের উপকারিতা বলে শেষ করা যায় না। এর মধ্যে একটি তো সবাই জানে। শিশুর পেটে কৃমি থাকলে বাসকের ছালের কাথ খাওয়ালে এর উগ্র তিক্ত স্বাদ কৃমি বের করে দেয়। বাসকের পাতায় ‘ভাসিসিন’ নামীয় ক্ষারীয় পদার্থ এবং তেল থাকে। শ্বাসনালির লালাগ্রন্থিকে সক্রিয় করে বলে বাসক শ্লেষ্মানাশক হিসেবে প্রসিদ্ধ। বাসক পাতার নির্যাস, রস বা সিরাপ শ্লেষ্মা তরল করে নির্গমে সুবিধা করে দেয় বলে সর্দি, কাশি এবং শ্বাসনালির প্রদাহমূলক ব্যাধিতে বিশেষ উপকারী। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় বাসকের ভেষজ গুণাবলি প্রমাণিত হয়েছে।
যদি বুকে কফ জমে থাকে এবং তার জন্যে শ্বাসকষ্ট হলে বা কাশি হলে বাসক পাতার রস মধুসহ খেলে কফ সহজে বেরিয়ে আসে। অনেকে বলেন, প্রস্রাবে জ্বালা-যন্ত্রণা থাকলে বাসকের ফুল বেটে ২-৩ চামচ মিছরি ১-২ চামচ সরবত করে খেলে এই রোগে উপকার পাওয়া যায়। বাসক পাতার রস ১-২ চামচ হাফ থেকে এক চামচ মধুসহ খেলে শিশুর সদি-র্কাশি উপকার পাওয়া যায়। বাসকপাতার রস স্নানের আধঘণ্টা আগে মাথায় কয়েক দিন মাখলে উকুন মরে যায়। জ্বর হলে বা অল্প জ্বর থাকলে বাসকের মূল ৫-১০ গ্রাম ধুয়ে থেঁতো করে ১০০ মিলি লিটার জলে ফোটাতে হবে। ২৫ মিলি লিটার থাকতে নামিয়ে তা ছেঁকে নিয়ে দিনে দুবার করে খেলে জ্বর এবং কাশি দুইই চলে যায়। বাসকের কচিপাতা ১০-১২টি এক টুকরো হলুদ একসঙ্গে বেটে দাদ বা চুলকানিতে লাগলে কয়েক দিনের মধ্যে তা সেরে যায়। বাসকপাতা বা ফুলের রস ১-২ চামচ মধু বা চিনি ১ চামচসহ প্রতিদিন খেলে জন্ডিস রেগে উপকার পাওয়া যায়। পাইরিয়া বা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়লে বাসকপাতা ২০টি থেঁতো করে ২ কাপ জলে সেদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ঈষদুষ্ণ অবস্থায় কুলকুচি করলে এই রোগে উপকার পাওয়া যায়। এগুলো ছাড়াও বাসকের পাতা সবুজ খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং পাতা থেকে হলদে রং পাওয়া যায়। বাসকপাতায় এমন কিছু ক্ষারীয় পদার্থ আছে, যায় ফলে ছত্রাক জন্মায় না এবং পোকামাকড় ধরে না বলে ফল প্যাকিং এবং সংরক্ষণ করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
"