মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসিফের বাজিমাত
ডিসটেন্স লার্নিং বা অনলাইন লার্নিংকে সারা দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে কোডম্যানবিডি কাজ শুরু করে। এ প্রসঙ্গে আসিফ বলেন, গতানুগতিক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোথাও গিয়ে না শিখে দেশের যেকোনো জেলা-উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে কেউ যেন ঘরে বসে গুণগত মানের স্কিল ডেভেলপমেন্ট করতে পারে তা ছিল কোডম্যানবিডির মূল লক্ষ্য
তিনি এক হাজারের ও বেশি প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন কোডম্যান বিডি, যেখানে ত্রিশজনের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। দশ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী তার প্রতিষ্ঠানে ফ্রিল্যান্সিং শিখে খুঁজে পেয়েছে আয়ের পথ। ৯ বছর বহুজার্তিক কোম্পানিতে চাকরির অভিজ্ঞতা তার। এতক্ষণ যার কথা বলা হলো তিনি সফল উদ্যোক্তা মিনহাজুল আসিফ। হাজার হাজার মানুষকে তিনি ফ্রিল্যান্সিং শিখিয়েছেন।
আসিফের পরিবারে স্ত্রী, দুই বছর বয়সি একটি ছেলে আছে। থাকেন ঢাকার রায়েরবাজার এলাকায়। আসিফ গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন ২০০৫ সালে। তারপর আহসানুল্লা ইউনিভার্সিটি অব সাইয়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। পরে এমবিএ করেন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের ওপর। পরিবারে এক ভাই তিন বোনের মধ্যে বড় আসিফ। পড়াশোনা শেষ করে সেলসম্যান হিসেবে একটি কোম্পানিতে তার কর্মজীবনের শুরু। এরপর টেলিকম কোম্পানি আইসিএক্স এবং অন্য একটি টেলিকম কোম্পানির ভেন্ডর কোম্পানিতে কেটেছে তার বেশ কিছুদিন। রবি আজিয়াটাতে রিজিওনাল অপারেশনের স্পেশালিস্ট হিসেবে ছিলেন তিন বছর। সর্বশেষ তার কর্মস্থল ছিল সামিট কমিউনিকেশনের নেটওয়ার্ক প্ল্যানিং অ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন ডিপার্টমেন্টে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের প্রতি আসিফের একটা আকর্ষণ আগে থেকেই ছিল। তিনি দেখলেন, এই কাজে চাকরির তুলনায় বেশি আয় করা সম্ভব। স্বাধীনতাও আছে অনেকটা। আবার অন্যদের শিখিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করা যায়। এসব কারণে চাকরি ছেড়ে তিনি ফ্রিল্যান্সিং বেছে নেন বলে জানান। আসিফ বলেন, শুধু নিজেই ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করে থেমে থাকিনি আমি। আমি চেয়েছি ফ্রিল্যান্সিংয়ের আলো অনেক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। আমি চেয়েছি, স্কিল ডেভেলপমেন্ট করে অন্যরা আমার মতোই স্বাবলম্বী হোক।
একসময় আসিফ মনে করলেন, নিজে ফ্রিল্যান্সিং করলেই হবে না। অন্যদের শিখিয়ে তাদের আয়ের পথ খুঁজে দিতে হবে। তার প্রতিষ্ঠান কোডম্যানবিডির যাত্র শুরু ২০১৭-১৮ সালে। ডিসটেন্স লার্নিং বা অনলাইন লার্নিংকে সারা দেশে প্রতিষ্ঠিত করতে কোডম্যানবিডি কাজ শুরু করে। এ প্রসঙ্গে আসিফ বলেন, গতানুগতিক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোথাও গিয়ে না শিখে দেশের যে কোনো জেলা-উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে কেউ যেন ঘরে বসে গুণগত মানের স্কিল ডেভেলপমেন্ট করতে পারে তা ছিল কোডম্যানবিডির মূল লক্ষ্য। কোডম্যানবিডি প্ল্যাটফরম থেকে দশ হাজারেরও বেশি স্টুডেন্টকে আমরা ডিজিটাল স্কিল বিষয়ে ট্রেনিং দিয়েছি। কোডম্যানবিডিতে দুশোর অধিক ব্যাচ সম্পন্ন হয়েছে। প্রতি ব্যাচ এ ৬০-১০০ জন ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকেন। তিনি জানান, কোডম্যানবিডির স্টুডেন্টরা এই পর্যন্ত দশ মিলিয়ন ডলারের ওপর রেমিট্যান্স দেশের জন্য নিয়ে এসেছে। বর্তমানে কোডম্যানবিডিতে মিনহাজুল আসিফের অধীনে ত্রিশজনের বেশি তরুণ কাজ করছেন। আসিফের কাছে যারা ফ্রিল্যান্সিং শিখেছেন তাদের অনেকেই এখন কোডম্যানবিডিতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। কোডম্যানবিডি ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করে দেয়। গত বছর ‘কোডম্যানবিডি’ অসংখ্য সফল ফ্রিল্যান্সার ও ফ্রিল্যান্স উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য স্বীকৃতিস্বরূপ ই-লার্নিং প্ল্যাটফরম হিসেবে রাইসিং ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০২২ পেয়েছে। চাকরিতে মাস শেষে নিশ্চিত আয়ের সুযোগ ছিল। ফ্রিল্যান্সিংয়ে আয় সব সময় সমান হয় না। ঝুঁকি তো কিছুটা ছিলই। তাও ২০১৭ সালের ঘটনা। যখন ফ্রিল্যান্সিং এখনকার মতো এত পরিচিত ছিল না। মানুষ নানা কথা বলত। চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসা তার অনেক কাছের মানুষই ভালো চোখে দেখেনি। অবশ্য এসব তিনি একদমই পাত্তা দেননি। আসিফ বলেন, অনলাইনকে অনেকে তখন বিশ্বাস করত না। আমার ৪-৫টা ব্যাচ যখন শেষ হয়, অনেক স্টুডেন্টকে আমি নিজের হাতে শিখিয়ে, সাপোর্ট দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল করে তুলি। পাশাপাশি ক্লাস ভিডিওগুলো ইউটিউবে রাখতাম যাতে মানুষ বুঝতে পারে আমার অনলাইন ট্রেনিং কেমন। খুব বেশি দিন লাগেনি। দুবছরের মাথায় অনেক সফল ফ্রিল্যান্সার তিনি তৈরি করতে সক্ষম হন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে।
কোডম্যানবিডি ছাড়া তিনি ওয়েব ব্যাটেলিয়ন এজেন্সিী প্রতিষ্ঠাতা। এই এজেন্সিতে ১৫ জন লোক কর্মরতে আছে। এটি ফ্রিল্যান্স ক্লায়েন্ট, লোকাল ক্লায়েন্ট ও ইন্টারন্যাশনাল ক্লায়েন্টদের প্রজেক্ট বেসিস কাজ করে থাকে। আসিফ বলেন, ‘বিশটির ও বেশি ওয়েব ও গ্রাফিক এজেন্সি’র সঙ্গে স্থায়ী চুক্তি রয়েছে। যখনি তাদের ওয়েব ডেভেলপার, গ্রাফিক ডিজাইনার, সাইবার সিকিউরিটি এক্সপার্ট বা ইউএই ডিজাইনারের প্রয়োজন হয়, আমরা স্টুডেন্টদের সিভি প্রদান করে থাকি। সেখান থেকে তারা আমাদের স্টুডেন্টদের বাছাই করে নিয়ে জব প্রদান করে থাকেন। বর্তমানে তার ওয়েব ব্যাটালিয়ন এজেন্সিীথেকে ফ্রিল্যান্স সার্ভিস থেকে প্রতি মাসে গড়ে সাত থেকে আট হাজার ডলার আয় হয়।’
মিনহাজুল আসিফ আইটি উদ্যোক্তা হিসেবে ২০২৩ সালে ‘যুব উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে অসাধারণ অবদান’র জন্য ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড’, ‘যুব উন্নয়ন অ্যাওয়ার্ড’, ‘লার্ন অ্যান্ড আর্ন বেস্ট মেন্টর’, ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যারিয়ার অ্যাওয়ার্ড’, ‘বেস্ট এড-টেক উদ্যোক্তা’, ‘বিজনেস ডাইজেস্ট সাইনিং পার্সোনালিটি অ্যাওয়ার্ড’সহ অনেক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তরুণদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার পাশাপাশি ডিজিটাল স্কিলে দক্ষ করে ফ্রিল্যান্সিং করে দেশের রেমিট্যান্সে অবদান রাখুক সেজন্য আরো ব্যাপক আকারে কাজ করে যেতে চান তিনি। অসংখ্য আইটি উদ্যোক্তা তৈরি হবে। যারা নিজেরা যেমন উদ্যোক্তা হবে। আবার উদ্যোক্তা তৈরিও করবে- এমনটাই তার স্বপ্ন।
"