কামরুজ্জামান তোতা
শান্তি প্রতিষ্ঠায় মডেল মসজিদ
বিশ্বে কোনো দেশে (১৪৭৫৯৮ বর্গমাইলের আয়তনে) একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক মসজিদ নির্মাণ এটাই প্রথম। সরকারি উদ্যোগ ও অর্থায়নে একই সঙ্গে এতগুলো মসজিদ নির্মাণের এই মহতী উদ্যোগ জাতীয় ইতিহাসে শুধু নয়, মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। মুসলিম বিশ্বের কোনো দেশের মুসলিম শাসক বা সরকারপ্রধান একসঙ্গে ৫৬০টি মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই অসাধারণ উদ্যোগ ইতিহাসের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ প্রধানমন্ত্রীর এই মহতী উদ্যোগের কথা যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে।
প্রধানমন্ত্রীর ভাবনায় মসজিদ
শেখ হাসিনার ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে উন্নত মসজিদ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে ওই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৮ হাজার ৭২২ কেটি টাকা ব্যয়ে এপ্রিল, ২০১৭ থেকে ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত মেয়াদে ১ম প্রকল্প বাস্তবায়নে অনুমোদিত হয়। সংশোধিত অনুমোদিত প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী মডেল মসজিদের জন্য ৪০ শতাংশ জায়গা নির্ধারণ করা হয়। জেলাপর্যায়ে চারতলা ও উপজেলাপর্যায়ে তিনতলা এবং উপকূলীয় এলাকায় চারতলা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক
কেন্দ্র নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
করা হয়।
মুসলিম শাসনামলে মসজিদ ও তার ইতিহাস
মুসলিম শাসনামলে জামে মসজিদ সরকারি ভবন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। কারণ খুতবা (জুমার নামাজের আগে দেওয়া ভাষণ) শাসকের স্বীকৃতির পরিচয় বহন করত এবং তা সার্বভৌমত্বের ঘোষণা হিসেবে কাজ করত। মসজিদ ধর্মানুরাগের এবং একই সঙ্গে এর পৃষ্ঠপোষকের ক্ষমতা ও আদশের প্রতিফলন ঘটাত।
মসজিদ একটি আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ সমর্পিত হওয়া। প্রায় প্রত্যেক মসজিদ স্থাপত্যেরই একটি সাধারণ গাঠনিক রূপ থাকে। যেমন : মূল প্রার্থনা কক্ষ, ছাদের ওপর স্থাপিত অর্ধ-বৃত্তাকার গম্বুজ এবং উঁচু মিনার। এ গঠনের ব্যতিক্রমও চোখে পড়ে। বিশেষ করে বিভিন্ন ভূখণ্ডের মানুষের সংস্কৃতি, আবহাওয়া, ভূ-প্রকৃতি, শাসনকাঠামো, রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভৃতি- সব দিকই সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডের ধর্মীয় স্থাপত্য নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার পর মুলমানদের ধর্মীয় প্রয়োজনে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মুসলমানদের জন্য প্রয়োজন সমবেতভাবে প্রার্থনা করার মতো একটি প্রশস্ত স্থান, বিশেষ করে শুক্রবারে সমবেতভাবে জামাতে নামাজ পড়ার সময়। মুসল্লিদের সবাইকে প্রার্থনায় নেতৃত্বদানকারী ইমামের পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হয়। একমাত্র অপরিহার্য স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মিহরাব-কিবলা (দক্ষিণ এশিয়ায় পশ্চিম) নামাজের জন্য নির্ধারিত নির্দেশনা অনুযায়ী এই কিবলা দেয়াল ফেরানো থাকে মুলমানদের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থস্থান কাবার দিকে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের পূর্ববর্তী সাড়ে পাঁচ শ বছরের মুসলিম শাসনামলে অসংখ্য মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, তবে বাংলায় (বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, বাংলার দুই অংশেই) মসজিদ স্থাপত্যের রীতি বিকশিত হয়েছিল। বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা বখতিয়ার খলজি (১২০৪-৬) রাজধানী লখনৌতির সর্বত্র একাধিক মসজিদ, মাদরাসা এবং খানকাহ নির্মাণ করেছেন। তবে তেরো এবং চৌদ্দ শতকের শুরুর দিকের খুব কম ইমারতই এখনো টিকে আছে। ত্রিবেণী অবস্থিত জাফর খান গাজীর মসজিদটি সুনির্দিষ্ট তারিখ বিশিষ্ট (১২৯৭ খ্রি./৬৯৭ হিজরি) এ সময়ের একমাত্র মসজিদ। দুর্ভাগ্যবশত ইমারতটি ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটি একটি আয়তাকার, বহু গম্বুজের বিশাল আয়তনের স্তম্ভভিত্তিক নির্মাণরীতির ইমারত ইট দিয়ে তৈরি এই মসজিদের দেয়ালের গায়ে পাথরের আস্তরণ রয়েছে। এই ব-দ্বীপ অঞ্চলে সহজলভ্য কাদামাটি থেকে সহজেই তৈরি করা সম্ভব বলে অতি প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা অঞ্চলের স্থাপত্য নির্মাণে ইট
ঐতিহ্যবাহী উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশের ধ্বংসপ্রাপ্ত কিন্তু বিশালায়তনের ময়নামতী ও পাহাড়পুর
বিহারের (সাত থেকে বারো শতক) উদাহরণ পাওয়া গেছে।
সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মডেল মসজিদের গুরুত্ব
ইসলামের প্রকৃত রূপ জনগণের মধ্যে তুলে ধরার জন্য বঙ্গবন্ধু তার সাড়ে তিন বছরের শাসন আমলে ইসলামের খেদমতে বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। স্বল্পকালে তিনি ইসলামের জন্য যতটা অবদান রেখে গেছেন তৎকালীন বিশ্বে তা নজিরবিহীন উদাহরণের সৃষ্টি করে।
বঙ্গবন্ধুর হাতে প্রতিষ্ঠিত এই ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ১৯৭৫-এর মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে এবং বাস্তবায়নে দেশব্যাপী ইসলামি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা। শান্তির ধর্ম ইসলামের শাশ্বত স্বরূপ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যথাযথভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা একান্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি ও ইমানদার মুসলিম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ইসলামের মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছিল।
ইসলামের মানবতাবাদী শিক্ষার আলোয় আলোকিত ছিল বঙ্গবন্ধুর কর্মজীবন। বঙ্গবন্ধু তার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনুধাবন করেছিলেন সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন- ইসলামের শাশ্বত শিক্ষা, ভ্রাতৃত্ববোধ, পরমতসহিষ্ণুতা ও ন্যায়বোধের মতো মৌলিক গুণাবলি ও এর বাণীর প্রচার ও প্রসার দরকার, তেমনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বাস্তবায়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণও প্রয়োজন। আর এর জন্য প্রয়োজন একটি অভিন্ন প্ল্যাটফরম, যার মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস, দর্শন, আইন, সংস্কৃতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এসব মৌলিক উদ্দেশ্যেই বঙ্গবন্ধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন।
মডেল মসজিদের ধরনগুলো
তিন ক্যাটাগরিতে মসজিদগুলো নির্মিত। ‘এ’ ক্যাটাগরিতে ৬৯টি চারতলার মডেল মসজিদ ৬৪টি জেলা শহরে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় নির্মিত। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ২৩৬০ দশমিক শূন্য ৯ বর্গমিটার। উপজেলায় ১৬৮০ দশমিক ১৪ বর্গমিটার আয়তনের ‘বি’ ক্যাটারির মসজিদ ৪৭৫টি। আর উপকূলীয় এলাকা ২০৫২ দশমিক ১২ বর্গমিটার আয়তনের ‘সি’ ক্যাটাগরির মসজিদ ১৬টি। জেলা সদর ও সিটি করপোরেশন এলাকার মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ১ হাজার ২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। অন্যদিকে উপজেলা ও উপকূলীয় এলাকার মডেল মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ৯০০ মুসল্লি নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা রাখা হয়। এসব মসজিদে সারা দেশে প্রতিদিন ৪ লাখ ৯৪ হাজার ২০০ জন পুরুষ ও ৩১ হাজার ৪০০ জন নারী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।
অবকাঠামোগত সুবিধা ও কার্যক্রম
মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে নারী ও পুরুষদের পৃথক ওজু ও নামাজ আদায়ের সুবিধা, লাইব্রেরি, গবেষণা ও দীনি দাওয়াত কার্যক্রম, পবিত্র কোরআন হেফজ, শিশুশিক্ষা, অতিথিশালা, বিদেশি পর্যটকদের আবাসন, মৃতদেহ গোসলের ব্যবস্থা, হজযাত্রীদের নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণ, ইমামদের প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ব্যবস্থা রাখা হয়। ইমামণ্ডমুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিসের ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রতিটি মসজিদ নির্মাণে ব্যয়
১. জেলা শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার টাকা। ২. উপজেলাপর্যায়ে ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। ৩. উপকূলীয় এলাকায় ১৩ কোটি ৬০ লাখ ৮২ হাজার টাকা। সারা দেশে নির্মাণাধীন এসব মসজিদের ভৌত অবকাঠামো গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
"