হানজালা শিহাব

  ০৮ মে, ২০২৩

স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণা ও বাস্তবতা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপ দেওয়ার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার আগে স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে কেউ পরিচিত ছিল না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর সরকারের মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব; সবাই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য এগিয়ে আসার কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তবে স্মার্ট বাংলাদেশ বা স্মার্ট বলতে কী বোঝায়, এই ধারণা কীভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব; এ সম্পর্কে কেউ ব্যাখ্যা দিচ্ছেন না, বলছেন না। অনেকের বক্তব্য হচ্ছে, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে নাগরিকদের স্মার্ট হতে হবে, শিক্ষার্থীদের স্মার্ট হতে হবে, দেশবাসীকে স্মার্ট হতে হবে ইত্যাদি। কিন্তু স্মার্ট জিনিসটা কী, কীভাবে সেটা হওয়া সম্ভব? সেই ধারণা আমাদের অনেকেরই হয়তো নেই।

সম্প্রতি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা সফরে গিয়ে স্মার্ট শহর বা স্মার্ট দেশের বাস্তব ধারণা তৈরি হয়েছে আমার। আমরা যেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি, মমতা ব্যানার্জির পশ্চিমবঙ্গের সরকার কলকাতার অদূরে নিউটাউন এলাকাকে স্মার্ট টাউন হিসেবে গড়ে তুলে তার বাস্তব রূপ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যের আগে স্মার্ট বাংলাদেশ বা স্মার্ট বলতে কী বোঝায়, অন্যদের মতো এ সম্পর্কে আমারও কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে সফরের পর সেই ধারণা ও বাস্তবতা আমার দুচোখ অবলোকন করেছে।

স্মার্ট টাউনে যা দেখেছি

১. স্মার্ট যাত্রী ছাউনি; ২. স্মার্ট ট্রাফিক সিগন্যাল; ৩. স্মার্ট রোড ডিভাইডার; ৪. স্মার্ট গাড়ির গতি নির্ধারণ যন্ত্র; ৫. স্মার্ট লাইটিং; ৬. বিভিন্ন যানবাহনের জন্য আলাদা স্মার্ট সড়ক; ৭. স্মার্ট আন্ডার পাস; ৮. স্মার্ট পার্কিং; ৯. স্মার্ট মেলা প্রাঙ্গণ; ১০ স্মার্ট দোকানপাট ও বাসাবাড়ি।

পরিকল্পিতভাবে একটি এলাকাকে স্মার্ট টাউন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। যাত্রী ছাউনিতে আপনি বাসের জন্য অপেক্ষা করবেন। সেখানে টিভি স্ক্রিনে আপনি দেখতে পারবেন বাস কতক্ষণ পর আসছে, এখানে কোন বাস আসছে, কোথা থেকে আসছে, কোথায় যাবে, আপনাকে কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, এই যাত্রীতে বসে আপনি আবার আপনার হাতের মোবাইলটি চার্জ দিয়ে নিতে পারবেন। সেই ব্যবস্থা রয়েছে।

যাত্রী ছাউনি কিংবা সড়কের পাশে পেতে রাখা বেঞ্চে বসে আড্ডা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যাত্রী ছাউনিসহ কিছু কিছু বেন্সের সঙ্গে স্মার্ট লাইটিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। সৌরবিদ্যুৎচালিত লাইটগুলো সন্ধ্যা হলে অটো জ্বলে ওঠে আর ভোরের আলো ফুটলে অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে যায়। কোথাও কোথাও যাত্রী ছাউনিতে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। ব্রেকফাস্ট বা ফাস্টফুড হোক সেরে নিতে পারছেন অপেক্ষমাণ যাত্রীরা। কিছুদূর পরপর সড়কের পাশে স্মার্ট টয়লেট রয়েছে। নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করে প্রাকৃতিক কাজ সেরে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে সেখানে।

স্মার্ট ট্রাফিক সিগন্যাল

কলকাতা শহরের কাছের এই পরিকল্পিত স্মার্ট নগরীতে ট্রাফিক সিগন্যাল আপনার দৃষ্টি কারবে। লাল বাতি জ্বলে উঠলে কোনো গাড়ি সামনে আগায় না। সেখানে ট্রাফিক পুলিশ থাকুক বা না থাকুক। আবার সবুজ বাতি জ্বলে উঠলে গাড়ি চলতে থাকে। এটি শুধু স্মার্ট নগরীতে নয়, এমন দৃশ্য খোদ কলকাতায়ও, যেখানে পুরান ঢাকার মতোই সড়ক, অলিগলি ও বাসাবাড়ি এবং ফুটপাতের দৃশ্য। কিন্তু ট্রাফিক সিগন্যাল পুরো পশ্চিমবঙ্গে একইভাবে কার্যকর।

স্মার্ট রোড ডিভাইডার

এমনভাবে রোড ডিভাইডারগুলো করা হয়েছে, পথচারীরা ইচ্ছে করলেই যখন-তখন রোডের এক পাশ থেকে পার হয়ে অপর পাশে যাওয়ার সুযোগ নেই। যানবাহনে যাত্রী তুলতে আলাদা লেন রয়েছে। দ্রুতগতির গাড়িগুলোর জন্য আলাদা নেন এবং সাইকেলের জন্য আলাদা লেন ও পথচারীর জন্য প্রশস্ত ফুটপাত রয়েছে। একই সঙ্গে ডিভাইডার ও ফুটপাতের পাশে ব্যাপক গাছপালা থাকায় আপনার হেঁটে যেতেও বেশ ভালোই লাগবে।

গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রক স্মার্ট যন্ত্র

গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সড়কের মাঝখানে লাইট পোস্টের মতো গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্রে গাড়ির গতি উঠে যাচ্ছে। কোনটি নির্ধারিত গতি অতিক্রম করছে তাও রেকর্ড হচ্ছে। ফলে সবাই নির্ধারিত গতিতে গাড়ি চালানোর চেষ্টা করছেন। এতে সড়ক দুর্ঘটনা কম হচ্ছে।

স্মার্ট লাইটিং

যাত্রী ছাউনি বা পথচারীদের আরামের জন্য বেঞ্চে স্মার্ট লাইটিং ছাড়াও সড়কের মূল লাইটিংগুলো স্মার্ট। সেগুলো সৌরবিদ্যুৎচালিত। সন্ধ্যা হলে অটো জ্বলে ওঠে আর ভোরের আলো ফুটলে বন্ধ হয়ে যায়। রাতে স্মার্ট লাইটিংয়ের রং-বেরঙের আলোয় সড়কগুলো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

স্মার্ট আন্ডার পাস

বিভিন্ন যানবাহনের জন্য আলাদা লেনের বিষয়ে এরই মধ্যে আলোচনা করেছি। কলকাতা মূল শহরের কাছেই গড়ে ওঠা স্মার্ট নগরীর আরেকটি বিষয় দৃষ্টি কাড়বে আপনার। সেটি হচ্ছে, স্মার্ট আন্ডার পাস বা সাবওয়ে তথা পথচারীদের জন্য পাতাল পথ। বিশ্ববাংলা মোড়সহ পশ্চিমবঙ্গের স্মার্ট নগরীর বিভিন্ন সড়কে সাবওয়ে বা পথচারীদের জন্য পাতাল পথ রয়েছে। সেখানে আছে চলন্ত সিঁড়ি। ভেতরে স্মার্ট লাইটিং, মার্বেল টাইলসের গড়ে তোলা ঝকঝকা পথ। কোনো পথচারী চলন্ত সিঁড়ির সামনে গেলে অটো এটি চলতে শুরু করে। আবার মানুষ নেমে গেলে সেটি অটো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অতিরিক্ত বিদ্যুতের খরচ বেঁচে যাচ্ছে। আর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জাঁকজমকপূর্ণ এই আন্ডার পাসগুলোতে লোকজনও চলতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।

স্মার্ট পার্কিং

সাইকেল, মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন গাড়ির জন্য আলাদা আলাদা স্মার্ট পার্কিং রয়েছে। সড়কের পাশেই এসব পার্কিংয়ে নির্ধারিত স্থানে সাইকেল, নির্ধারিত স্থানে মোটরসাইকেল এবং অন্য গাড়িগুলোর জন্য নির্ধারিত পার্কিংয়ে সবাই পার্ক করছে। বিশেষ করে সাইকেল, মোটরসাইকেলের পার্কিংগুলোতে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সেখানে কোনো নিরাপত্তাকর্মী নেই। যে যার মতো বাইসাইকেল বা মোটরবাইক রেখে যাচ্ছেন। আবার অফিস শেষে নিয়ে যাচ্ছেন।

স্মার্টমেলা প্রাঙ্গণ

পশ্চিমবঙ্গের স্মার্ট নগরীতে একটি স্মার্টমেলা প্রাঙ্গণ গড়ে তোলা হয়েছে। বছরের বিভিন্ন সময় এখানে নানা ধরনের মেলা বসে। যদিও চলতি বছর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কোনো মেলার আয়োজন ছিল না এখানে। স্মার্ট এই মেলা প্রাঙ্গণে আলাদা পার্কিং ব্যবস্থা, প্রশস্ত এই প্রাঙ্গণের চারপাশে মানুষের চলাচলের পর্যাপ্ত রাস্তা এবং মনোরম পরিবেশ রয়েছে। ফলে মেলা প্রাঙ্গণে মেলা বসলেও পাশের সড়কে যানজটের সুযোগ নেই। তাছাড়া বিশ্ববাংলা স্মরণী হয়ে চিংড়িহাটা, সল্টলেক, নিউটাউন মোড়, বিশ্ববাংলা মোড়, বিমানবন্দর সড়ক, টাটা ইকোনমিক জোন হয়ে সাপুর্জী বা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সড়কসহ পরিকল্পিত এই নগরীর প্রতিটি সড়ক বেশ প্রশস্ত ও আলাদা লেন হওয়ায় ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়া যানজট চোখে পড়ে না।

স্মার্ট দোকান পাট ও বাসাবাড়ি

প্রকল্পিতভাবে গড়ে তোলা স্মার্ট নগরীর প্রতিটি দোকানপাট ও মার্কেটের পাশে গাড়ি পার্কিংয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকায় মূল সড়কে মার্কেটের কোনো প্রভাব পড়ে না। সেই সঙ্গে চারপাশে পর্যাপ্ত খোলা জায়গা ও গাছপালা রয়েছে। একইভাবে গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক এলাকাগুলো। বহুতল ভবনগুলোর চারপাশে পর্যাপ্ত খালি জায়গা, বাগান ও গাড়ি পার্কিংব্যবস্থা। সবকিছু পরিপাটি। ঢাকার গুলশান-বনানী এলাকার মতো সড়ক ও বাড়িগুলো পরিচ্ছন্ন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের এই নগরে বাসাভাড়া তুলনামূলক অনেক কম। সেই সঙ্গে বাসাবাড়িগুলোতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকায় বিদ্যুতের সাশ্রয় হচ্ছে।

শেষ কথা

পশ্চিমবঙ্গর মমতা ব্যানার্জি সরকার শুধু একটি এলাকাকে স্মার্ট নগরীতে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। এতে সময় লেগেছে প্রায় এক যুগ। এখনো কিছু কাজ চলমান। কিন্তু পুরো পশ্চিমবঙ্গ বা ইন্ডিয়াকে স্মার্ট দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি মমতা ও নরেন্দ্র মোদির পক্ষে। আর তা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা বলা কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারপ্রধান পুরো দেশকেই স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন ২০৪১ সালের মধ্যে। তা বাস্তবায়ন যে বেশ কষ্টসাধ্য, এ কথা বলাই যায়।

লেখক : সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close