ইয়াসমীন রীমা

  ০১ মে, ২০২৩

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে গ্রামে গ্রামে সবুজ বেষ্টনী

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১ থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে জরুরি বিভাগে প্রতি মাসেই গড়ে ৩-৪ জন পানিতে ডুবে যাওয়া শিশু আসছে। গত এক বছরে প্রায় ৩০ জন শিশু পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছে, যাদের বাড়ি হাসপাতালের পাশের ইউনিয়নগুলোতে অন্য ইউনিয়নগুলোর অবস্থান হাসপাতাল থেকে দূরবর্তী হওয়ার কারণে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই পানিতে পড়ে যাওয়া শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে

আবহাওয়া বার্তার মতো অনিবার্যতা নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে হাজির হচ্ছে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর মর্মস্পর্শী সংবাদ।

ব্রাহ্মণপাড়ায় পুকুরের পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু- দৈনিক ভোরের সূর্যোদয়- ১১ এপ্রিল ২০২৩ইং। তিনস্থানে পানিতে ডুবে চার শিশুর মৃত্যু- দৈনিক আজকের পত্রিকা- ৯ এপ্রিল ২০২৩ইং খেলতে গিয়ে ফিরল না দুই ভাই- প্রতিদিনের বাংলাদেশ- ৮ এপ্রিল ২০২৩ইং

কুমিল্লা ব্রাহ্মণপাড়ার উপজেলার মাধবপুর গ্রামের কৃষক পরিবারের গৃহিণী আকলিমা খাতুনের ১৮ মাস বয়সি একমাত্র কন্যা তোবামনি। বিকেলে বাড়ির উঠোনে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলা করছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর শিশুটিকে দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন পরিবারের সদস্যরা। একপর্যায়ে সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাড়ির পাশের একটি পুকুরে শিশুটিকে ভাসতে দেখেন স্থানীয় বাসিন্দারা। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় পরিবারের লোকজন শিশুটিকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে স্থানীর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। স্বজনদের ধারণা, তোরামনি বাড়ির উঠোনে খেলা করার কোনো একসময় পাশের পুকুরের পানিতে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শুধু তোবামনি নয়, প্রতি বছর এমন হাজারো শিশুর মৃত্যু হচ্ছে পানিতে ডুবে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, গত বছর জেলায় ২৫৮ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। চলতি বছরের চার মাসে দাউদকান্দি উপজেলায় ২২ জন, মুরাদনগর উপজেলায় ৩০, দেবীদ্বার উপজেলায় ২১ জন শিশুর সলিল সমাধি ঘটে। গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’র এক সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ- পানিতে ডুবে মারা যাওয়াদের মধ্যে ৮২ শতাংশ শিশু। যাদের বয়স ১৮ বছরের নি¤েœ। তাদের ৮০ শতাংশ ৯ বছরের কম। পরিবারে সদস্যদের অসর্তকতার কারণে সিংহভাগ মৃত্যু ঘটছে। পানিতে ডুবে মৃতদের ৮১ শতাংশ পরিবারের সদস্যদের অগোচরে পানির সংস্পর্শে যায় এবং ডুবে মারা যায়। সমাজ ও স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠন শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ, ২০২২ সালে সারা দেশে পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ১৯ হাজার ৬৭১ শিশুর। এর মধ্যে ৬২ দশমিক ৩৬ শতাংশ ছেলে, ৩৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ মেয়ে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করেছে শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সি শিশু। তাদের সংখ্যা ৯৬০ জন, যা মৃতের ৫৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্ত্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১ থেকে ৫ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে জরুরি বিভাগে প্রতি মাসেই গড়ে ৩-৪ জন পানিতে ডুবে যাওয়া শিশু আসছে। গত এক বছরে প্রায় ৩০ জন শিশু পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছে, যাদের বাড়ি হাসপাতালের পাশের ইউনিয়নগুলোতে অন্য ইউনিয়নগুলোর অবস্থান হাসপাতাল থেকে দূরবর্তী হওয়ার কারণে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই পানিতে পড়ে যাওয়া শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। জলাঞ্চল হিসেবে খ্যাত কুমিল্লার অন্যতম উপজেলা মনোহরগঞ্জ। ডা. নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিষয়টি তাকে ভাবিয়ে তোলে ২০১১ সালে উদ্যোগ নেন শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমানোর প্রচেষ্টায়। ছুটে যান বিভিন্ন গ্রামে। পুকুর পাড়ে সবুজ সবজি চাষ করতে কিংবা সবুজ নেট দিয়ে বেষ্টনী দিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। এ প্রক্রিয়াটি কয়েকটি গ্রামে সাড়া ফেলে। গ্রামের মানুষ এগিয়ে আসে।। দিশাবন্ধ গ্রামের আকতার হোসেন বলেন, ‘বর্তমানে আমার পুকুর পাড়ে সবজি চাষ করছি। এতে শিশুরা পুকুর পাড়ে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। পানিতে পড়তে পারে না। সঙ্গে সবজি দিয়ে পরিবারের চাহিদা মেটাতে পারছি।’ লৎসর গ্রামের মায়মুনার খেদোক্তি, যদি এমন ব্যবস্থাটি আগেই করা হতো তাহলে তার একমাত্র পুত্রসন্তান শাহপরান পানিতে ডুবে মারা যেত না। যার ফলে তার সাজানো সংসার ভেঙে যেত না। বিশেষ করে উপজেলার লৎসর ও দিশাবন্ধ গ্রামে মানুষ সবুজ বেষ্টনী পদ্ধতি প্রয়োগ করার ফলে হ্রাস পেতে থাকে শিশুমৃত্যু হার। দিশাবন্ধ গ্রামের খিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আল আমিন ভূঁইয়া বলেন, ‘আগে প্রতিদিন এক থেকে দুটি শিশু পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটত। এই সবুজ বেষ্টনী দেওয়ার ফলে গত এক বছরে লৎসর ও দিশাবন্ধ গ্রামের কোনো শিশু পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। তবে বর্তমানে বিনা পারিশ্রমিকে পর্যাপ্ত আগ্রহী ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া এবং গাছ ও নেট ক্রয়ে অর্থায়ন এবং নিয়মিত সেই ব্যয় নির্বাহ একটি চ্যালেঞ্জ।’

এই প্রসঙ্গে কুমিল্লা জেলা ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নিসর্গ মেরাজ চৌধুরী বলেন, ‘আমি তখন মনোহরগঞ্জ উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করছিলাম। অত্র এলাকায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি অধিকাংশ শিশু মারা যায় সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে যখন মায়েরা গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত থাকেন, এদের অধিকাংশ ঘটে বর্ষা মৌসুমে যখন পুকুর-নালা বৃষ্টির পানিতে ভরা থাকে। বাড়ির আঙিনায় অবস্থিত পুকুর বা জলাশয়ের চারপাশে একটি নিরাপদ বেষ্টনী গড়ে তোলার ব্যাপারে অভিভাবক পর্যায়ে রয়েছে চরম উদাসিনতা। অজ্ঞতা ও জনসচেতনতার অভাবে জলাশয়ের পাশে নেই কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী। বিষয়টিকে আশঙ্কাজনক হিসেবে চিহ্নিত করে মনোহরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার উদ্যোগে ‘গ্রিন ফেন্সিং’ বা সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করি। বর্তমানে কুমিল্লার দেবীদ্বার ও দাউদকান্দি উপজেলায় ওই কার্যক্রম চালু হয়েছে।’

২০২১ সালে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে মনোহরগঞ্জ উপজেলার লৎসর ও দিশাবন্ধ গ্রামে ‘গ্রিন ফেন্সিং’ বা সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের আওতায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো হচ্ছে-

* উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের সমন্বয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িসমূহ চিহ্নিতকরণ।

চিহ্নিত বাড়িগুলোতে মায়েদের সঙ্গে উঠান বৈঠক আয়োজন।

* পরিবারের নিজস্ব বা এলাকার দানশীল ব্যক্তিদের অর্থায়নে সবুজ বেষ্টনী প্রণয়ন।

* ১০-১৫ জন তরুণ-তরুণী সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন।

* স্বেচ্ছাসেবক দলকে পানিতে ডোবা শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাস নিশ্চিত করে প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান।

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেশন অ্যান্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) পরিচালক ড. আমিনুর রহমান বলেন, ‘দিনের প্রথম ভাগে শিশুদের নিবিড় তত্ত্বাধানে রাখা হলে দেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার ৭০ শতাংশ রোধ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে গ্রামভিত্তিক শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র সফলভাবে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে কার্যকর। এখন সারা দেশে ১০টি উপজেলায় ৩২০০টি কেন্দ্রে প্রায় ৮০ হাজার শিশুকে দিবাযত্ন কেন্দ্রে বা আঁচলে রাখা হয়। প্রশিক্ষণপাপ্ত একজন নারী শিশুদের দেখাশোনা করেন। যিনি ‘আঁচল মা’ নামে পরিচিত। আঁচল মায়ের সঙ্গে আরেকজন নারী সহযোগী রয়েছে।’

কুমিল্লা সালেহা উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিন মোল্লা বলেন, ‘শিশুদের সাঁতার শেখার গুরুত্বের ওপর স্কুলের শিক্ষকরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। সাঁতার একটি খুবই উত্তম ব্যায়াম। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সাঁতারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে পারেন। পাঠ্যপুস্তকেও সাঁতার শেখার গুরুত্ব বিষয়ে অধ্যায় সংযুক্ত করা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা সচেতনতাই পারে কেবল পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করতে। এ ক্ষেত্রে আমার সবার সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।’

পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু বর্তমানে নীরব মহামারির আকার ধারণ করেছে। বিশ্বে শিশুমৃত্যুর শীর্ষ ১০টি কারণসমূহের মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হলো পানিতে ডুবে মৃত্যু। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির ২০২২ সালের এক সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ, দেশে প্রতি বছর প্রায় ১৯ হাজার শিশু-কিশোর পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। তাদের গড় বয়স ১-১৫ বছর। অর্থাৎ প্রতিদিন ১-৫ বছর বয়সি ৪০টিরও বেশি শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। পানিতে ডুবে অকালমৃত্যু কারো কাম্য নয়। বর্তমান সরকার পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তবে কেবল সরকারি উদ্যোগ পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধ সম্ভব নয়। পারিবারিক, সামাজিক ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতা ছাড়াও ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতাহীন এ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব নয়। জনসচেতনতার অভাবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close