দেশের জন্য কিছু করতে চান আজাদুল
রকেট তৈরির ধারণা দিয়ে রকেট্রি ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন আজাদুল হক। পেয়েছেন এক কোটি টাকা। পুরুস্কার পেয়ে তিনি বলেছেন, এই টাকা আমার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নয়। পুরস্কারের সব অর্থ দিয়ে মডেল রকেটের গবেষণা, উন্নয়নের পাশাপাশি যন্ত্রাংশ কেনা হবে। নাসায় প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে ম্যাক্স গ্রুপের পাওয়ার ডিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। কাজ করছেন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। আজাদুল হক কাজের ফাঁকে মডেল রকেট তৈরি এবং উৎক্ষেপণের কাজ করছেন। আজাদুল হকে রকেট তৈরি নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
আজাদুল হকের পৈতৃক বাড়ি বরিশালে। বাবা ফজলুল হক। ছয় বোনের একমাত্র ছোট ভাই তিনি। ১৯৯২ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী গৃহিণী। দুই ছেলে। বড় ছেলে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার। আমাজনে কর্মরত। ছোট ছেলের মাস চারেকের মধ্যে গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবে। স্ত্রী, দুই ছেলে আমেরিকায় থাকেন। আজাদুল হক গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সে তৃতীয় টার্ম পড়ার সময় আমেরিকায় চলে যান। ইলেকট্রিক ইনঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি সেখান থেকে নেন।
নাসায় কাজ : প্রায় পাঁচ বছর আজাদুল নাসার কাজ করেছেন। তিনি বলেন, ‘১৯৯৮ সালের প্রথমদিকে আমি আবার চলে গেলাম আমেরিকায়। ফিরে গেলাম নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে লকহিড মার্টিনের কন্ট্রাক্টে। কাজ করেছি লাইফ সায়েন্স ডেটা সিস্টেমে, টেলিসায়েন্স সাপোর্ট সেন্টারে (টিএসসি)।’ তিনি আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তর এনার্জি কোম্পানি কিন্ডার মর্গানে ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। আজাদুল বলেন, ‘যখন শুরু করেছিলাম; তখন এ কোম্পানি ছিল ২০ বিলিয়ন ডলারের। যখন চলে আসি; তখন সেটা ছিল ১৩৫ বিলিয়ন ডলারের!’ এ ছাড়া ডিস্কটেক নামে এক কোম্পানিতে প্রোগ্রাম ম্যানেজার, হিউস্টনের কম্পিউটার এক্সপোতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
কনভেনশন অব এনআরবি ইঞ্জিনিয়ার্স : ২০১৯ সালে ম্যাক্স গ্রুপের সহায়তায় কনভেনশন অব এনআরবি ইঞ্জিনিয়ার্সের আয়োজন করা হয়। বিশ্বের ৩০০ ইনঞ্জিনিয়ার এই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে। এই কনভেনশনের মূল ধারণা ছিল ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীরের। তিনি পুরো কনভেনশনের দায়িত্ব দেন কনভেনর হিসেবে আজাদুল হককে। এই প্রোগ্রামের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজাদুলের সঙ্গে তখন প্রধানমন্ত্রী সরাসরি কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী আজাদুলকে দেশে কাজ করার কথা বলেন। আজাদুল তখন প্রধানমন্ত্রীকে নাসার মতো একটি স্বাধীন স্পেস এজেন্সি গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন প্রস্তাবের কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী তা মনোযোগ সহকারে শোনেন, যা আজাদুলের জীবনে বড় আনন্দদায়ক ঘটনাগুলোর একটি বলে তিনি জানান।
ছোটবেলার স্বপ্ন ডালপালা গজিয়েছে : এখন তিনি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, ছোটবেলায় তিনি তাই স্বপ্ন দেখতেন। প্রচন্ড উদ্বাবনী ক্ষমতার মেধাবী মানুষ আজাদুল। তিনি বলেন, দেশে রকেট্রি ইকো সিস্টেম তৈরি করতে হবে। মডেল রকেট তৈরি করা তারই একটি ধাপ। দেশে রকেট তৈরি, উৎক্ষেপণ ইত্যাদির কোনো নীতিমালা নেই। এই বিষয়গুলো নিয়ে তিনি কাজ করছেন।
তার হাত ধরে : হানিফ সংকেতের সঙ্গে প্রথম সেল এনিমেশন করেন আজাদুল। যেটা বিটিভিতে আনন্দমেলা অনুষ্ঠানে দেখানো হয়। থিডি এনিমেশন একসময় পর্দা কাঁপিয়েছে। বাংলাদেশে থিডি এনিমেশনের প্রযুক্তির পাশাপাশি বিলবোর্ড, পোস্টার প্লিন্টপ্রযুক্তি তিনি প্রথম নিয়ে আসেন। তিনি তখন স্টার অ্যাডভার্টাইজার্সের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির তৃতীয় কর্মকর্তা তিনি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফেকট্রেকচার (কম্পিউটার ল্যাব, নেটকওয়ার্ক) নিয়ে তিনি কাজ করেন। নর্থ সাউথের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন তার হাতেই হয়। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহবশেষ দেশে আনা, হিউস্টনে শহীদ মিনার নির্মাণসহ অসংখ্য সমাজকল্যাণমূলক কাজে তিনি ভূমিকা রেখেছেন।
রকেট্রি ইকো সিস্টেম তৈরি : ইকো সিস্টেম তৈরি করতে হবে। ক্ষেত্র তৈরি করা চাই সবার আগে। আজাদুল বলেন, ‘আমি ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে মডেল রকেট তৈরি করব। তাদের যন্ত্রাংশ কিনে দেব। লালমনিরহাটে প্রায় ৭০০ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু এভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। আমি সেখানকার স্টুডেন্টদের সাহায্য করব।
১২৪ জনে সেরা হলেন কীভাবে : ১২৪ জন রকেট তৈরির ধারণা জমা দিয়েছিল। এর মধ্যে প্রথম হয়ে এক কোটি টাকা জিতেছেন আজাদুল। ধারণা জমাদানকারীদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিল স্টুডেন্ট। তারা বড় বড় রকেট তৈরির কথা বললেও উৎক্ষেপণের পর কী হবে, কীভাবে কতটা সুফল মিলবে। এ বিষয়গুলো ছিল না বললেই চলে। কিন্তু আজাদুল যেমন রকেট উৎক্ষেপণের কথা বলেছেন। তেমনি এর সুফল, রকেট বানানোর ক্ষেত্র তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত ছিল। এসব তার সেরা হওয়ার অন্যতম কারণ বলে জানা যায়। তবে মডেল রকেটের ফিগার আউট করা গেলে, এর অনেক অংশ রপ্তানি করাও যাবে বলে তিনি জানান।
রকেটের সঙ্গে জড়িত কম্পোনেন্ট : রকেটের জন্য চাই ফ্লাইট কম্পিউটার। এটা কিনে আনলে হবে না। আজাদুল চান, বাংলাদেশিরা এটি ডিজাইন করবে। ফ্লাইট কম্পিউটারের পেছনে তার অনেক টাকা চলে যাবে। এরই মধ্যে তিনি ল্যাবে ছোট ছোট টেস্ট রকেট তৈরি করেছেন। নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। আজাদুলের ইচ্ছা রকেট উৎক্ষেপণ প্যাড তৈরি করবেন। অন্যরা এটি ব্যবহার করতে পারবে। তবে এজন্য রকেট তৈরি করে সাবমিট করার পর কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলেই তবে ব্যবহার করা যাবে।
দ্বীপে রকেট উৎক্ষেপণ প্যাড : বাংলাদেশের অনেক দ্বীপ আছে। ২০৪১-এর মধ্যে আমরা এই রকম একটি দ্বীপে রকেট উৎক্ষেপণ প্যাড তৈরি করতে পারি, যা অন্য দেশের কাছে ভাড়া দেওয়া যাবে। জাহাজে করে রকেট, স্যাটেলাইট আসবে। এখানে তারা উৎক্ষেপণ করবে। ইচ্ছে করলেই যখন তখন রকেট উৎক্ষেপণ করা যায় না। কক্ষপথ বিবেচনা করে নির্দিষ্ট সময়ে উৎক্ষেপণ করতে হয়। বলেন আজাদুল।
১৯৭১-এর প্রেরণা : বাংলাদেশ ২০৪১-এর মধ্যে রকেট তৈরি, উৎক্ষেপণের সাহস দেখাতেই পারে। এই অধিকার, সাহস, বাঙালিদের আছে। যেটা এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে। আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা আছে। দেশে বসেই কাজ করা সম্ভব স্পেস ইকোনমি নিয়ে। সেই সাহসটাই তরুণদের মধ্যে গেঁথে দিচ্ছেন আজাদুল। তার মতে, ইকো সিস্টেম তৈরি করার সায়েন্টেফিক গাটস আমাদের আছে।
আসছে নতুন কিছু : সব সময় নতুন কিছু করতে তিনি ভালোবাসেন। তিনি জানান, এবার নতুন এক ব্লিডিং ম্যাটেরিয়াল নিয়ে আসছেন। ম্যাক্স গ্রুপ থেকে। যেটা বাজারে সাড়া ফেলবে বলে তার ধারণা। এ জন্য মাস তিনেক অপেক্ষা করা লাগবে।
দেশকে ভালোবাসেন : অর্থ, গাড়ি, বাড়ি, জৌলসপূর্ণ জীবন। কোনো কিছুই আজাদুলকে টানে না। শুধু দেশপ্রেম, দেশের জন্য কিছু করাই যেন তার ধ্যান-জ্ঞান। দেশটাকে বড় ভালোবাসেন তিনি। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে চাই।
"