বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী
পুরান ঢাকার বিরিয়ানির রাজ্যে...
পুরান ঢাকার বিরিয়ানির স্বাদ আর ঐতিহ্যের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। মোগল আমল থেকেই পুরান ঢাকার বিরিয়ানি সবার কাছে ভীষণ জনপ্রিয়। প্রায় ৪০০ বছর থেকে বাংলায় রাজত্ব করে আসছে মোগল খাদ্যভাণ্ডারের সুস্বাদু এই খাবারটি। অনেক পথ পেরিয়ে আজও বিরিয়ানির সেই ঐতিহ্য পুরান ঢাকাবাসী ধরে রেখেছে। জিভে জল আনা সুস্বাদু সব খাবারদাবারের ভিড়েও স্বাদ, গন্ধ ও মানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী পুরান ঢাকার কাচ্চি, তেহারি ও চিকেন বিরিয়ানির দোকানগুলো। চলুন ঢুঁ মেরে আসি পুরান ঢাকার অলিগলিতে ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বিরিয়ানির রাজ্য থেকে
হাজি বিরিয়ানি
হাজি বিরিয়ানি পুরান ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম রেস্তোরাঁ। ১৯৩৯ সালে হাজি মোহাম্মদ হোসেন এক হাঁড়ি বিরিয়ানি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করেন। তার বিরিয়ানির স্বাদ ও খাবারের মান ভালো হওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে হাজির বিরিয়ানির নামডাক। পরে এর ব্যবসায় নাটকীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি শহরের সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। কালক্রমে এই বিরিয়ানির ব্যবসার দায়িত্ব বুঝে নেন তার ছেলে হাজি গোলাম হোসেন। আর ব্যবসাটি বর্তমানে চালিয়ে যাচ্ছেন তার নাতি হাজি মোহাম্মদ সাহেদ হুসাইন। হাজির বিরিয়ানির দোকানে বিক্রি হয় শুধু কাচ্চি বিরিয়ানি। এর বিশেষত্ব হলো গরুর মাংসের পরিবর্তে শুধু খাসির মাংস এবং ঘি বা বাটার অয়েলের পরিবর্তে সরিষার তেল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সম্পূর্ণ দেশীয় সব মশলা ব্যবহার করা হয় বলে স্বাদে গন্ধে আজও সবার কাছে প্রিয় এই হাজির বিরিয়ানি।
হাজি নান্না মিয়ার বিরিয়ানি
সময়টা তখন ১৯৬০ বা ’৬২! বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বেশ খানিকটা সামনে অবস্থিত মৌলভীবাজারে জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন হরেকরকম মানুষের আনাগোনা চলত। তাদের মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির মানুষকে এক বেলা ভালো খাওয়ানো ও নিজের জীবিকার জন্য বাজারের এক কোণে মাদুর বা চাটাই বিছিয়ে মোরগ-পোলাও বিক্রি শুরু করলেন নান্না মিয়া। এরপর তিনি খাবারের দোকানে কাজ নেন ও মাওলানা দ্বীন মোহাম্মদ সাহেবের খাদেম হন। দ্বীন মোহাম্মদ সাহেবই নান্নাকে বাবুর্চি হওয়ার জন্য মূলত উৎসাহ জোগান। নান্না তখনকার ঢাকার বিখ্যাত পেয়ারা বাবুর্চির অধীনে রান্না শেখা শুরু করেন। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে নান্না বাবুর্চির কাজ শুরু করেন এবং ঢাকার মৌলভীবাজারে প্রথম মোরগ-পোলাও বিক্রি করেন। বর্তমানে হাজি নান্না মিয়ার ছেলে হাজি মোহাম্মদ আবদুল্লাহ এই ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। বাবার গড়ে যাওয়া ঐতিহ্য ও আবেগ ধরে রেখে বিক্রি করে চলেছেন নান্না মিয়ার সেই বিখ্যাত মোরগ-পোলাও এবং সঙ্গে যুক্ত করেছেন গরুর তেহারি, খাসির বিরিয়ানি, খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি, খাসির রেজালা, ডিম পোলাও, বোরহানি, টিকিয়া ও ফিরনি।
নারিন্দার ঝুনুর মোরগ পোলাও
ঝুনুর বিরিয়ানির জন্ম ১৯৭০ সালে নুর মোহাম্মদের হাত ধরে। ওই বছর থেকে নারিন্দায় স্বল্প পরিসরে তিনি মোরগ-পোলাও বিক্রি করতে শুরু করেন। তার মেয়ে ঝুনুর নামেই তিনি দোকানের নাম রাখেন। ১৯৮৮ সালে নূর মোহাম্মদ মারা গেলে তার ভাই এটির দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তার ভাইয়ের ছেলে দোকানটি পরিচালনা করছে। অরিজিনাল চিনিগুঁড়া চালের পোলাও, দেশি মোরগের সিদ্ধ মাংস, দেশি মুরগির ডিম, গিলা-কলিজার কোরমা আর পেঁয়াজ-শসার মিক্সড সালাদ দিয়ে পরিবেশন করা হয় এই পোলাও।
হানিফ বিরিয়ানি
হানিফ বিরিয়ানির যাত্রা শুরু ১৯৭৫ সালে। হাজী মোহাম্মদ হানিফ এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। ২০০৫ সালে হাজী হানিফের মৃত্যুর পর তার ছেলে হাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম রনি ব্যবসার হাল ধরেন। কাচ্চি বিরিয়ানি হানিফের প্রধান আকর্ষণ। ঠিক হাজির বিরিয়ানির উল্টা পাশে দোকান হওয়ায় হানিফ বিরিয়ানির খাবারের মান এবং স্বাদ দুটোই খুবই মেইন্টেন করা হয়, না হলে নাজিরাবাজারে হাজির সঙ্গে ব্যাবসা করে টিকে থাকা এত সহজ নয়।
কলকাতা কাচ্চি
কলকাতা কাচ্চির বিশেষত্ব হচ্ছে তারা শুধু খাসির মাংসের কাচ্চিই বিক্রয় করে। ভালোভাবে রান্না করা নরম তুলতুলে খাসির মাংস, অতিরিক্ত মিষ্টি বা ঝালবিহীন পরিমাণমতো সিদ্ধ পোলাও চাল এবং আলু, সাথে টক-মিষ্টি আলুবোখারা সমেত স্বাদে বেশ ভালো এই কাচ্চিটি। এছাড়া এর সঙ্গে বোরহানি, জালি কাবাব ও ফিরনির ব্যবস্থাও রয়েছে। বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে সাতরওজার এ সুপরিচিত ছোট্ট দোকানটি।
রয়েল রেস্তোরাঁ
লালবাগ কেল্লার মোড় সংলগ্ন রয়েল রেস্তোরার খাবারের বৈচিত্র্য অন্যদের চাইতে আলাদা। হরেকরকম কাবাব ও অন্যান্য মুখরোচক খাবারের মধ্যে তাদের তেহারি আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। স্বাদের ভিন্নতা ও পরিবেশ সুশৃঙ্খল হওয়ার দরুন এর চাহিদা সারাব ছর একইরকম থাকে।
গ্রেট সুলতান অরিজিনাল কাচ্চি
এই লিস্টের সবচেয়ে নবীন কিন্তু পরিবেশ ও খাবারের মানে টেক্কা দেওয়ার মতো সংযোজন গ্রেট সুলতান অরিজিনাল কাচ্চি। এটির অবস্থান ঠিক কলকাতা কাচ্চির উল্টো পাশে। তাদের হালকা মিষ্টি স্বাদের বাসমতি কাচ্চি ও মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো।
যত দিন যাচ্ছে এলাকাগুলোতে বিরিয়ানির দোকান দিয়ে ছেয়ে যাচ্ছে। তবে শুধু পুরোনো ঢাকাবাসীদের বিরিয়ানিপ্রীতি আছে এটা বললে ভুল হবে, নতুন ঢাকার মানুষদেরও বিরিয়ানির প্রতি আসক্তিটা কোনো অংশে কম নয়। পুরান ঢাকার বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকানগুলোতে অনেক দূর থেকে মানুষ বিরিয়ানি খেতে আসে। দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই সুস্বাদু বিরিয়ানির সুঘ্রাণ পাওয়া যায়। সুঘ্রাণযুক্ত বিরিয়ানির প্রতি এই তীব্র আবেগ-ভালোবাসা গর্বের সঙ্গে টিকে থাকুক।
"