আর এম রিফাত
বনসাই প্রেমী রায়হানের গল্প

বিশ্বের এক ভয়ানক নাম করোনা। যার ভয়াল গ্রাসে জনজীবন থমকে গিয়েছিল। ওই সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব ক্ষেত্রে অবস্থা ছিল শোচনীয়। যা ছিল সবার জন্য দুঃখজনক। তবে কারো কারো জন্য এই করোনাকালীন আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। ব্যতিক্রম ঘটেনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এনামুল রায়হানের জীবনেও। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-১৬ বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাসা যশোরের মণিরামপুরের ঝাঁটা গ্রামে। করোনাকালীন যখন অবসর সময়গুলো কাটছিল না, ওই সময়টাতে তার মনে প্রবল হতাশা ও বিষণ্নতা ভর করেছিল। সেই নিকষ সময়গুলো কাটত স্মার্টফোনে, ফেসবুক স্ক্রল স্ক্রল করতে করতে এক দিন দেখলেন বনসাইয়ের কথা। এটা দেখার পর অনলাইন ঘাটাঘাটি করে বনসাই সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন। নেমে পড়লেন বনসাইয়ের খোঁজে। বনসাই করার বাসনা থেকেই অনলাইন মাধ্যম ও খুলনা বিভাগের ৩৫টি নার্সারি ঘুরে একে একে সংগ্রহ করতে লাগলেন বনসাই। ছোট থেকেই সে বৃক্ষপ্রেমী ছিলেন, প্রকৃতির প্রতি তার ভালোবাসাকে বাস্তবে রূপ দিতে নিজ বাসার ছাদে ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন নার্সারি। এরপর থেকেই রায়হানের অবসর সময় কাটে ছাদ বাগানে। একে একে ছাদ বাগানে বিশের অধিক বনসাই যুক্ত করলেন। বনসাইয়ের পাশাপাশি সেখানে ফলদ ও সবজি দিয়ে বাগান পূর্ণ করেন। এদিকে ছাদ বাগানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতেই না হতেই, সময় ঘনিয়ে এলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার। দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়, মায়ার বন্ধন বনসাই ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতে হয়। প্রথম প্রথম ছাদ বাগান ছেড়ে থাকতে তার কষ্ট হতো। পরবর্তী সময়ে ভাবলেন ইবিতেও বনসাই বাগান করার। সে থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়াউর রহমান হলে, হলের দুই দুইটি ব্লক রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় এক ব্লক থেকে আরেক ব্লকে আসা যাওয়ার রাস্তা রয়েছে। সেই জায়গাটি কাজে লাগালেন তিনি। চলাচলের দুই পাশে বনসাই সংগ্রহ করে এনে পরিচর্যা শুরু করলেন। সময়ের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলেও গড়ে তুললেন একটি বনসাই বাগান। দুই ব্লকের দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ তলার করিডোর থেকে তাকালেই রায়হানের বাগানের দেখা মেলে। এই বনসাই বাগানটি জিয়া হলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। প্রায় সময়ই সেখানে বসে হলের শিক্ষার্থীরা আড্ডার আসর জমায়। তার এমন উদ্যোগের প্রশংসা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী হানিফ হোসেন বলেন, ‘প্রকৃতির প্রতি তার রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা। এমন আগ্রহ দেখে আমার নিজেরও ইচ্ছা হয় বাগান করার।’ রায়হানের বাড়ির আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদ বাগান মিলে ৪৫ এর অধিক বনসাই, ৩০ এর অধিক ফলজ ও ৫ এর অধিক সবজিসহ রয়েছে ইনডোর প্লান। ছাদ বাগানের পাশাপাশি ইনডোরও সাজিয়েছে বনসাই দিয়ে। ভেতরে তাকালে দেখা মেলে বিভিন্ন রকম ফুলের গাছসহ নানা ধরনের বৃক্ষ। যা সবাইকে মুগ্ধ করে। তিনি জানান, তার ছাদ বাগানে দেশি বট, চায়না বট, তেঁতুল, কদবেল, পেয়ারা, বাগান বিলাস, ঝুমুর, চন্দন, গোলাপ, কাটামোকট, বতল বিলাস, লক্ষ পাকুড়, পাকুড়, জবা, বারবাডোস চেরি, টগর, অর্জুন বলকামিনীসহ নানা জাতের বনসাই রয়েছে। তার বাড়ির ছাদে রয়েছে আপেল, আতা, আঙ্গুর, জামরুল, সফেদা, পেয়ারা, অস্ট্রেলিয়ান লেবু, স্ট্রবেরি, স্ট্রবেরি পেয়ারা, থাই পেয়ারা, আমলকী, মালবেরি ব্লাকবেরি, আপেল কুল, জলপাই, আমড়া, মালটা, কাগুজে লেবু, কাটিমন আম, রামবুটান, কদবেলসহ নানা প্রজাতির ফলজ উদ্ভিদ। যেখানে আপেল ব্যতীত সব গাছে ধরেছে ফল। এছাড়াও রয়েছে শসা, লাউ, সিম, মিষ্টিকুমড়াসহ বিভিন্ন প্রকারের সবজি।
রায়হান বলেন, ‘একজন শিশুকে যেভাবে মানুষ করতে যে ধরনের পরিশ্রম এবং সময় দেওয়া হয়। ঠিক তেমনি বনসাই ও ফলজ বাগানে আমাকেও সেভাবে সময় দিতে হয়। একসঙ্গে নিজেই দুটি বাগান দেখাশোনা করি। বাড়ির ছাদ বাগান দেখার জন্য প্রায়ই আমাকে গ্রামে যেতে হয়। এতে আমার কোনো ধরনের কষ্ট হয় না। বাগান করার ভেতরে মনে মাঝে যে আনন্দ কাজ করে তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। এটি আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে।’
বৃক্ষগুলো টিকিয়ে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘বনসাই টিকিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। বাগান টিকিয়ে রাখতে জৈব সার, নিচ কুটি, হাড়ের গুঁড়া, ডিমের খোসা, খৈল পচাসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়।’
বনসাই এ তার স্বপ্নের কথাও তিনি জানিয়েছেন, ‘ভবিষ্যতে জেলার বৃক্ষমেলায় একক প্রদর্শনী হিসেবে ২০০ গাছ রাখার ইচ্ছা রয়েছে।’ এছাড়াও তিনি বলেন, ‘আমার থেকে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে বনসাইয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মেছে। তারা আমার কাছে আসলে, যে বৃক্ষগুলোর ডাল থেকে বনসাই করা সম্ভব হয়। তা আমি তাদের ফ্রিতে দেওয়ার পাশাপাশি পদ্ধতি শিখিয়ে দেই। এভাবেই মানুষ ও প্রকৃতির ভালোবাসা নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে থাকতে চাই।’
"