নাজমুন্নাহার

  ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

নিরাপদ পুষ্টি চাহিদা পূরণে ছাদকৃষি

সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে জনসংখ্যা, কমেছে কৃষিজমির পরিমাণ। বেড়েছে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যের চাহিদা। বাড়ছেনা সেই হারে আবাদি জমি। তাইতো বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টায় আবিষ্কৃত হচ্ছে উন্নত কৃষি উপকরণ, হাইব্রিড, অধিক পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ ও স্বল্পমেয়াদি কিন্তু অধিক ফলন সংবলিত জাত। দেশে বিদেশে সর্বত্র নিজ খাদ্যের চাহিদা পূরণসহ অন্যত্র রপ্তানির আশায় দিন দিনই তৈরি হচ্ছে নতুন কৌশল ও সম্ভবনাময় খাত। ছাদকৃষি বা ছাদ বাগানের কিঞ্চিত সমাধান হতে পারে।

ছাদবাগান কোনো নতুন ধারণা নয়। সৌন্দর্য পিপাসু মানুষরা সব সময় সুন্দরকে সবার আগে স্থান দিয়েছে। তাইতো অতি প্রাচীন সভ্যতায়ও ছাদবাগানের ইতিহাস চোখে পড়ে। খ্রিস্টের জন্মেরও পূর্বে মেসোপটিয়াম ও পারস্যের জুকুরাক নামীয় পিরামিড আকৃতির উঁচু পাথরের স্থাপনায় বাগান ও ছোট গাছ লাগানোর জন্য স্থান নির্ধারণ করার নিদর্শন পাওয়া যায়। ১১ শতকের পুরোনো কায়রো শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ হয়। এ ভবনগুলোর সবগুলোর ছাদেই বাগান স্থাপন করা হয়েছিল। পম্পেই নগরীর কাছেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন রোমান ভিলায় কেবল একটি নির্দিষ্ট ছাদ তৈরিই করা হয়েছিল বাগান করার জন্য। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান যার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া না গেলেও বর্তমানে ইরাকের মসুল শহরের কাছেই আরেক ঝুলন্ত উদ্যানের নিদর্শন পাওয়া যায়।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিনই শহরে বাড়ছে ইট পাথরের দালান। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ প্রকৃতি। তবে শহুরে কিছু মানুষ এখনো ভুলেননি তাদের আপন শিকড়। মাটি আর সবুজ প্রকৃতির টানে নিজস্ব বাড়ির ছাদে তৈরি করছে ছাদবাগান। ছাদবাগান থেকে রূপ নিচ্ছে ছাদকৃষি। কেবল বাংলাদেশেই নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের শহুরে কৃষি ব্যবস্থার শৌখিন পদযাত্রায় ছাদকৃষি গড়ে উঠলেও বর্তমানে কেবল শৌখিনতায় আটকে নেই ছাদকৃষি। ব্যাপক বাণিজ্যিক উৎপাদন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব না হলেও ধীরে ধীরে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের তাপমাত্রা দিনদিনই বাড়ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের কৃষি ব্যবস্থা। পরিবেশ রক্ষা আর শহরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে অনেক দেশেই বাড়ির ছাদ, বারান্দা, ফুটপাত, সরকারি খাস জমি, পার্ক, অব্যবহার্য জায়গার প্রতিটি পর্যায়ে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে উদ্যান ফসল ও বাহারি ফুলের গাছের সমন্বয়ে তৈরি করা হচ্ছে সবুজ নগরায়ণ।

আমাদের দেশেও ছাদবাগানের মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ে শহরে সবুজায়ন শুরু হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে ছাদবাগান শুরু হলেও ছাদবাগানের গুরূত্ব উপলব্ধি করতে পেরে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু বিভাগ বা অধিদপ্তর আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি তথ্য সার্ভিস ছাদবাগানে আগ্রহীদের কারিগরি জ্ঞান ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ছাদবাগানের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ছাদবাগানে আগ্রহ বাড়ানোর জন্য সরকার বাড়ির মালিকদের ১০ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স ছাড় দিচ্ছে। এতে অনেকে ছাদ বাগান করতে আগ্রহী হচ্ছে। তা ছাড়া প্রতি বছর ঢাকায় বৃক্ষ মেলার আয়োজন করা হয়। এই মেলায় কয়েক লাখ চারা গাছ বিক্রি হয়। বেশির ভাগ গাছই স্থান পায় রাজধানীর বিভিন্ন বাড়ির ছাদ, ব্যালকনি কিংবা বাসার সামনের খোলা জায়গায়। এতে যেমন সবুজ গাছপালার পরিধি বাড়ছে, ঠিক তেমনি বিক্রেতাদের আয়ও হচ্ছে। ফলে অধিক নার্সারি তৈরির প্রবণতা বাড়ছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।

নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান দিতে ছাদবাগানের গুরুত্ব অপরিসীম। আম, জাম, বড়ই, লিচু, আমড়া, পেয়ারা, ড্রাগন, কদবেল, স্ট্রবেরি, মাল্টা, ডালিম, আনার, লটকন, কলা, কামরাঙা, লেবু এমনকি ভিয়েতনামের ছোট জাতের নারিকেলের চাষও হয় ছাদবাগানে। বিভিন্ন প্রকারের শাক ও অন্যান্য সবজি, কাঁচামরিচ, শিম, লাউ, টমেটো, বেগুন যা দৈনন্দিন জীবনের পারিবারিক চাহিদা পূরণ করতে সচেতন ছাদ কৃষিপ্রেমীরা। বাজারের কেনা শাকসবজি ও ফলের চেয়ে নিজ উদ্যেগে লাগানো শাকসবজি ও ফল বেশি সতেজ, নিরাপদ এবং পুষ্টিগুণও বেশি। কেননা এতে কোনো কেমিক্যাল নেই। আমাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। নারীদের অধিক পরিমাণে আকৃষ্ট করতে পারলে ছাদকৃষি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এর জন্য প্রয়োজন অধিক প্রচার, সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা। এতে যেমন পরিবারের পুষ্টি নিশ্চিত হবে তেমনি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখারও সুযোগ সৃষ্টি হবে।

ছাদবাগান শুধু নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যেরই জোগান দেয় না, অধিক পরিমাণ ছাদবাগান গড়ে তুলা হলে এটি কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ বেশকিছু ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা কমিয়ে দূষণ কমাবে এবং পরিবেশের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করবে। তা ছাড়া ছাদবাগান তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ছাদবাগান পানিচক্র নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করা ছাড়াও জীববৈচিত্র্যের উন্নয়ন, শব্দ ও বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে। খাদ্য শৃঙ্খলে আনতে পারে নতুনত্ব। পাখিসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। একাকিত্ব বা মন খারাপের সহজ সমাধান হতে পারে এই ছাদকৃষি। ছাদবাগান মানসিক প্রশান্তি নিয়ে আসার পাশাপাশি পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করে। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের ছাদকৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারলে কৃষির প্রতি যেমন শিশুদের আগ্রহ বাড়বে, তেমনি মোবাইল বা কম্পিউটারে গেম খেলে চোখ ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। এছাড়াও সতেজ ও পুষ্টিকর খাবারে শিশুর শারীরিক গঠনসহ মেধা বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে ছাদকৃষি। তাই শুধু ঢাকা নয় সব বিভাগীয় শহরে, এমনকি গ্রামেও ছাদকৃষির ধারণা ও কলাকৌশল পৌঁছে দিতে পারলে অধিকতর সুফল পাওয়া যাবে।

অধিক জনসংখ্যার পুষ্টির চাহিদা পূরণে অল্প জায়গায় অধিক পরিমাণ শাকসবজি ও ফলমূলের গাছ লাগাতে ছাদবাগানের বিকল্প নেই। সরকারিভাবেও বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যেমন- সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৃষ্টির পানি এবং ভূ-উপরস্থ পানি ব্যবহার করে ছাদবাগান সম্প্রসারণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জায়গার স্বল্পতার কথা বিবেচনা করে ভার্টিক্যাল পদ্ধতিতেও ছাদবাগান করার সুপারিশ করা হয়েছে। জাতীয় কৃষিনীতিতে ছাদবাগানের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সবুজ প্রকৃতিতে ভরে উঠুক আমাদের দেশ। পাখির কিচিরমিচির শব্দে শুরু হোক কোলাহলময় নাগরিক জীবন।

লেখক : বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল

ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close