মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩

সাদীর মাসে আয় চার হাজার ডলার

সাত বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। হওয়ার কথা ছিল তার আইনজীবী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাস করলেও মাস্টার্স করা হয়নি। অর্থনীতির টানাপড়েনে তাকে খুঁজতে হয় আয়ের পথ। স্থায়ীভাবে এখন কাজ করেন বিদেশি দুটি কোম্পানির। নিজেও খুলেছেন এজেন্সি। মাসে তার আয় চার থেকে ছয় হাজার ডলার। জীবনযুদ্ধে সফল এই ফ্রিল্যান্সারের নাম সাদী রহমান।

মা চাইতেন ছেলে কম্পিউটার সংক্রান্ত কোনো কাজ করুক। কম্পিউটার শিখতে গিয়েই সাদী ফ্রিল্যান্সিংয়ের কথা জানতে পারেন। তখন কম্পিউটার, মোবাইল কিছুই ছিল না সাদীর। পরিচিত একজনের বাসায় গিয়ে কম্পিউটার চালাতেন। পরে মা ও এক বোনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুরোনো একটি কম্পিউটার কিনেন তিনি। দিনভর টিউশনি করাতেন। রাতে ফ্রিল্যান্সিংয়ের চর্চা চালিয়ে যেতেন। একপর্যায়ে সাদীর মনে হয়েছিল। তাকে দিয়ে কিছুই হবে না। একটি কাজও পাচ্ছিলেন না তিনি। তারপরও হাল ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হয়নি তার। পরিবারের কথা তাকে ভাবতে হয়েছে।

নিজ থেকে ইউটিউবে কাজ শেখার চেষ্টা করে সুবিধা করতে পারছিলেন না। কোর্স করবেন সে সামর্থ্য ছিল না সাদীর। সাব্বির নামে তার এক বড় ভাই তখন আপওয়ার্কে কাজ করত। শেষমেশ সাদী তার দারস্থ হন। তিনি সাদীকে ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজ পাবার খুঁটিনাটি কৌশল দেখিয়ে দেন। ২০১৬ সাল তার এভাবেই কেটে যায়। ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি আপওয়ার্কে পাঁচ ডলারের কাজের মাধ্যমে তার আয়ের শুরু। এই কাজের সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ২০০ ডলারের কাজ পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। আইন বিষয়ে পড়েও আইন পেশায় তার যাওয়া হয়নি। সাদীর গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলার শ্রীবরদী থানায়। ঢাকার উত্তরায় মা, স্ত্রী ও ভাইবোনদের নিয়ে তার বসবাস। বীর মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান মডেল স্কুল ওেথকে এসএসসি এবং শ্রীবরদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন তিনি। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি করেন।

ফ্রিল্যান্সিং হলো নানা রকম কাজের জায়গা। শুধু প্রয়োজন দক্ষতা। সাদী এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। সে কারণে ২০১৭ সালে তিনি মার্কেটিং রিলেটেড কাজ করেন। ২০১৮-১৯ সালে ওয়ার্ডপ্রেস ডেভেলপার হিসেবে ভালোই নজর কাড়েন সবার। ২০২০ থেকে ২০২২। এ সময়ে সিআরএম ডেভেলপার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘কর্নারআপ, দ্য বিএমএস কোম্পানি’ নামে দুটি কোম্পানির সঙ্গে স্থায়ীভাবে কাজ করছেন। ইউএসএ, কানাডা, ইউকে, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইন্ডিয়া, সুইডেন, নিউজিল্যান্ড ও ডেনমার্কের ছোট-বড় অনেক কোম্পানির মালিক এখন তার ক্লায়েন্ট। এ পর্যন্ত ৬০০ এরও বেশি প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করার কারিগর তিনি। এছাড়া কিছুদিন তিনি ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্ট্রাগ্রাম, লিংকডইনে অ্যাডভাটাইজিংয়ের কাজ করেছেন। ভালো কাজের জন্য গুগল থেকে সার্টিফিকেটও জুটেছে তার ঝুলিতে। Zoho CRM, HubSpot CRM, Pipedrive CRM, Zapier নিয়েও অনেক কাজ করেছেন বিগত বছরগুলোতে। এ পর্যন্ত আপওয়ার্র্কে তার কাজের সংখ্যা ৩০০ এর বেশি। ফাইবারে তিনি প্রজেক্ট বেসিস কাছ বেছে নেন।

নিজের অদম্য মনোবল। প্রথমদিকে বারবার ব্যর্থ হলেও ধৈর্য ধরে লেগে থাকা। পাশাপাশি মায়ের দোয়া তো ছিলই। সাদী এগুলোকে তার সফলতার নেপথ্যের কারণ বলে মনে করেন। জীবনের প্রথম আয় তার ৩ হাজার ৩২০ টাকা। এখন মাসে চার থেকে ছয় হাজার ডলার তার এমনিতেই আয় হয়। ভালো কাজ করলে স্বীকৃতি তো মিলবেই। সাদীর বেলায়ও তাই হয়েছে। তিনি বেসিস থেকে ডিস্ট্রিক্ট ইন্ডিভিজুয়াল ক্যাটাগরিতে বেস্ট ফ্রিল্যান্সার ২০২১ নির্বাচিত হন।

বাংলাদেশের ই-কর্মাস ইন্ডাস্ট্রিকে ডেভেলপ করার ভাবনা তার অনেকদিন ধরেই। এই ভাবনা থেকেই তিনি Amper Digital নামে একটি এজেন্সি খুলেছেন। তার পাটনার হিসেবে আছেন Todd Thiede নামে একজন। আর পাঁচজন কর্মী কাজ করছেন যার তিনজনই বাংলাদেশি। এজেন্সির কাজ সম্পর্কে সাদী বলেন, আমরা এমন একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে যাচ্ছি, যেখানে মানুষ সহজে ঘরে বসে কেনাকাটা করতে পারবে। ক্রেতারা তাদের পণ্য হাতে পাবে দ্রুততম সময়ে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই। উপরন্তু পেমেন্ট করার সম্পূর্ণ অথরিটি কাস্টমারদের দেওয়া হবে।

অনেক আগ্রহ নিয়ে তরুণ-তরুণীরা ফ্রিল্যান্সিয়ের জগতে আসেন। তবে এদের অধিকাংশই অল্প কদিনে গাছের শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়ে যান। নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারেন না মোটেই। এর কারণ হিসেবে সাদী বলেন, দক্ষতা এবং ধৈর্যের অভাব। তিনি বলেন, ফ্রিল্যান্সিং একটি ইন্টারন্যাশনাল মার্কেট প্লেস। এই প্লেসে শুধু দক্ষতা দিয়ে আয় করা সম্ভব। অন্যথায় কিছুদিন টিকে থাকলেও পরে মার্কেটপ্লেস থেকে ঝরে পড়ে যেতে হবে। সাদী নিজেও প্রায় এক বছর হাড়ভাঙা খাটুনি খেটেছেন। একটি টাকাও আয় করতে পারেননি। ওদিকে পরিবারে চরম অর্থনৈতিক সংকট ছিল। সেই দিনগুলোর কথা এখন আর মনে করতে চান না সাদী। তিনি বলেন, সারা দিন টিউশনি করে রাতে ফিরে কম্পিউটারের সামনে বসতাম। কখন ভোর হয়ে যেত টেরই পেতাম না।

ইউটিউব, ফেসবুকে ওমুক কোর্স করলেই লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। এমন চকলাদার বিজ্ঞাপনের বিষয়ে তিনি নতুনদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি নতুনদের জন্য ধৈর্য, এডুকেশন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করার ওপর গুরুত্ব দেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close