লিটন সামন্ত
মানুষের সুখানুভূতি যেভাবে তৈরি হয়
সুখ মানুষের এক অদম্য চাওয়া। সেই আদিকাল থেকেই মানুষ সুখে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করে আসছে। এই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। একসময় একটুখানি সুখানুভূতির জন্য প্রাচীন রোমের লোকজন অতি স্বচ্ছ ও সামান্য উষ্ণ পানি দিয়ে গোসল করত। এতে করে তারা কিছুটা হলেও সুখ অনুভব করত। তখনকার সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের গোসলের জন্য পানির ব্যবহারের পরিমাণটাও ছিল অনেক বেশি। যেমনটি আমরা আধুনিক কালে সুইমিংপুলের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। মূলত এভাবেই মানুষ স্বচ্ছ পানিতে গোসল করে সুখানুভূতি লাভ করত।
এরপর বহু শতাব্দী কেটে গেল। মানবসমাজে এসেছে অনেক পরিবর্তন। কিন্তু মানুষ সুখের নেশার পিছু ছাড়তে পারেনি। আর এই নেশার অংশ হিসেবে মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় ধূমপানের অভ্যাস। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মহামতি পিটারের শাসনামলে ধূমপানের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। সেখানে থেকে ইউরোপসহ পৃথিবীর প্রায় সব অঞ্চলে ধূমপায়ীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তখন থেকেই মানুষ ধূমপানে মাধ্যমে এক ধরনের সুখানুভূতি লাভ করত। এখন প্রশ্ন হলো ধূমপানের মাধ্যমে কীভাবে মানুষ সুখানুভূতি লাভ করে। মানুষ মূলত তামাকের মাধ্যমেই ধূমপান করে থাকে। বলাবাহুল্য, তামাকের অনন্য উপাদান হলো নিকোটিন। আর এই নিকোটিন শরীরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই শিহরণ বা এক ধরনের আনন্দ অনুভূতির জন্ম দেয়।
মানুষ যখন ধূমপান করে তখন মাত্র ১০ সেকেন্ডেই মস্তিষ্কের ডোপামিন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। যার মাধ্যমে এক ধরনের সুখানুভূতি তৈরি হয়। এর ফলে মানুষ এক বিশেষ আনন্দ লাভ করে এবং তামাকের প্রতি এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে। তবে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে, ধূমপান করাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণের মাধ্যমেও মানুষের শরীরে সুখানুভূতি তৈরি হতে পারে। যেমন- মাছ, মাংস, ডিম ও সবুজ শাক-সবজি খেলে মানুষের মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের লেবেল বেড়ে যায়। তখন মানুষ অনাবিল সুখানুভূতি লাভ করে থাকে। এই সেরোটোনিন মানুষের মুডকে উজ্জীবিত করে এবং শরীরে আনন্দণ্ডফুর্তির অনুভূতি তৈরি করে। এমনকি মস্তিষ্কে সেরোটোনিন দুশ্চিন্তা ও হতাশা থেকে মুক্তি দেয়। মানুষের ভালো ঘুমের জন্য সেরোটোনিনের গুরুত্ব অপরিসীম। সেরোটনিন মেলাটোনিনকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে মানুষের ভালো ঘুমের ক্ষেত্রে অবদান রাখে। আর যদি কোনো কারণে সেরোটোনিনের লেবেল কমে যায় তখন মানুষের মন খারাপ হয়। বিষণ্নতা বৃদ্ধিপায়।
মানুষ যখন তার প্রিয় জনের সান্নিধ্যে থাকে তখন এন্ডোরফিনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। আর এই এন্ডোরফিনের নিঃসরণ বাড়লে শরীরে ও মনে সুখের অনুভূতি জন্ম নেয়। এমনকি মানুষ যদি তার প্রিয় কোনো স্থানে যায় তখনো এন্ডোরফিনের নিঃসরণ বাড়ে। তখন হার্টে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে। এতেও মানুষের দেহে সুখানুভূতি তৈরি হয়। এই অবস্থাতে মানুষ ছোটখাটো ব্যাথার অনুভূতিও ভুলে যায়। মানুষ অন্য কারোর স্পর্শের মাধ্যমে সুখানুভূতি লাভ করতে পারে। অর্থাৎ স্পর্শের মাধ্যমে সুখকর অনুভূতি তৈরি হয়। মানুষ যখন অন্য কারো কাছ থেকে স্পর্শের ছোঁয়া পায় তখন মস্তিষ্কের সোমাটোসেনসরি কর্টেক্সে এক ধরনের কোষ সক্রিয় হয়। তখন ভালো লাগার অনুভূতি জন্মে। এটা জানা জরুরি যে, কোনো মানুষ কী পরিমাণ সুখী সেটা নির্ভর করে তার হ্যাপিনেস জিনের ওপর। জিন হলো বংশগতির ধারক ও বাহক। শরীর যে জিন সুখকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে হ্যাপিনেস জিন বলে। মূলত এই হ্যাপিনেস জিনই মানুষকে সুখী রাখতে সাহায্য করে। যার হ্যাপিনেস জিন যত সক্রিয় সে তত সুখী হয়।
মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগার অনুভূতি থাকে ১৬ থেকে ২৬ বছর পর্যন্ত। আর এই ২৬ বছরের পর থেকেই মানুুষের মস্তিষ্কে ঘটে এক ব্যাপক পরিবর্তন। অর্থাৎ এই বয়সের পর থেকেই মানুষের মস্তিষ্ক থেকে প্রতিদিনই প্রায়ই হাজার নিউরন মারা যেতে থাকে। মস্তিষ্কের নিউরনের মৃত্যু হার ঠেকানোর কোনো উপায় নেই। আর এই প্রক্রিয়া প্রতিটি মানুষের মাঝে আমৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। যার ফল স্বরূপ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সব বিষয়ে ভালো লাগার অনুভূতি কিছুটা হলেও লোপ পেতে থাকে। আবার মানুষের বয়স যখন ৪০ বছর অতিক্রম করে তখন শরীর থেকে পটাশিয়ামের লেভেল কমতে শুরু করে। মানবদেহের জন্য এই পটাশিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষের তারুণ্য ধরে রাখতে পটাশিয়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। পটাশিয়ামের লেভেল কমে গেলে মানুষের ভালো লাগার অনুভূতিও কমতে থাকে। সুখ এবং দুঃখ দুটি বিপরীত শব্দ। মানুষ যখন সুখ অনুভব করে তখন দুঃখ অনুভব করতে পারে না। আবার মানুষ যখন দুঃখ অনুভব করে তখন সুখ অনুভব করতে পারে না। আবার যদি কোনো কারনে মানুষের দুঃখের অনুভূতি তৈরি হয়। তখন মানুষের শরীরে ম্যাঙ্গানিজের আধিক্য বেড়ে যায়। তখন মানুষের মন অশান্ত হয়। তখন এই ম্যাঙ্গানিজ অশ্রুজল হয়ে দেহ থেকে বের হয়ে আসে। যে কারণে মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি অনুভব করে।
আবার অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি থেকেও মানুষের সুখানুভূতি তৈরি হয়। অর্থাৎ এটিকে প্রয়োজন থেকে অতিরিক্ত ভালো কিছু পাওয়াকে বুঝানো হয়। এ অবস্থায় মানুষের সুখকর অনুভূতি তৈরি হয়। আর এই সময়ে মানুষের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন কর্টিসলের মাত্রা বেড়ে যায়। যার কারণে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয় এবং ভালো লাগার অনুভূতি জাগে। মানুষ যখন কোনো মহৎ কাজ করে থাকে তখনো সুখানুভূতি জাগ্রত হয় এবং এই অনুভূতির ব্যাপ্তিকাল হয় দীর্ঘ।
লেখক : তথ্য অফিসার
পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
"