লিটন সামন্ত
চিকিৎসাব্যবস্থার উদ্ভব হলো যেভাবে...
প্রাচীনকালে সর্ব প্রথম চিকিৎসাব্যবস্থার সূচনা হয় গ্রিসে। সেই সময় জিউসের মন্দির প্রাঙ্গণে অসুস্থ বা রোগাক্রান্ত লোকজন আসত। গ্রিকবাসীরা জিউসকে স্বর্গ মর্ত্য ও পাতালের দেবতা বলে মনে করত। প্রাচীন গ্রিকদের ধারণা ছিল মানুষের শারীরিক অসুস্থতা হলো সৃষ্টিকর্তার কোনো না কোনো অভিশাপ। আর এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতেই অসুস্থ লোকজন জিউসের মন্দিরে ভিড় করত এবং দেবরাজ জিউসকে সন্তুষ্ট করতে বিভিন্ন ধরনের প্রার্থনা করত। অসুস্থতা থেকে মুক্তি পেতে চাইত।
তখন মন্দিরে নিয়োজিত পুরোহিত অসুস্থ ব্যক্তিদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার লক্ষ্যে কিছু মৌখিক পরামর্শ দিতেন। বলা হয় এটাই সর্ব প্রথম চিকিৎসা হিসেবে রোগীর প্রতি নির্দেশনা। পুরোহিতের এসব পরামর্শ রোগীর সুস্থতার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখত এবং অনেক রোগী আরোগ্য লাভ করত। তখন রোগীদের কাছে পুরোহিতের কদর বেড়ে গেল। পুরোহিতের সুযোগ্য পুত্র ছিলেন হিপোক্রেটাস। হিপোক্রেটাস তার পিতার কাছ থেকে চিকিৎসা বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্য অর্জন করেন।
সেই সময়ে চিকিৎসা বিদ্যাকে বলা হতো গুপ্ত বিদ্যা। আর গুপ্ত বিদ্যা সেইসব শিক্ষাকেই বোঝানো হয় যে শিক্ষা-দীক্ষা কোনো ব্যক্তি তার পিতার কাছ থেকে সন্তান শিখে থাকে। চিকিৎসা বিষয়ে অনেক জ্ঞান অর্জন করার কারণে হিপোক্রেটাসকে বলা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনেক বড় অবদান রাখেন। তিনি মনবিদ্যা ও শরীর বিদ্যার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেন। তার পিতা নিকোমাস ছিলেন ম্যাসিডনের রাজা অ্যামিনটোসের ব্যক্তিগত চিকিৎসক।
ভারতীয় মহান শাসক সম্রাট অশোক, তিনি মানবকল্যাণের লক্ষ্যে ৯টি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেন। তার ৯টি বই ছিল আলাদা, আলাদা বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে লেখা। তার মধ্যে দুটি গ্রন্থই ছিল। মানুষের মন ও শরীরকে কেন্দ্র করে। এসব বইয়ে শরীর ও মনের পূর্ণ বিবরণ ছিল। মুসলমান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ছিলেন মানুষের চিকিৎসা প্রসারের ক্ষেত্রে আলোর দিশারী। চিকিৎসা বিজ্ঞানী আল হাজেন তিনি সর্ব প্রথম বলেন, কোনো বস্তু থেকে আলো আসে বলেই মানুষ সেই বস্তুকে দেখতে পায়। তার এই মতবাদ পরবর্তী সময়ে চোখের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রাখে।
ইতালির বিখ্যাত চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি মানব শরীরের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অনেক জ্ঞান অর্জন করেন। মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি গিল্ট অব সেন্ট লুকের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এই সংগঠনটি ছিল চিকিৎসক ও চিত্রকরের একটি সংঘ। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি চিত্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশ কীভাবে কাজ করে তা জানার চেষ্টা করেন। ওষুধের জেনেরিক নাম রোমান ভাষা থেকে এসেছে। অনেক রোগের নাম গ্রিক শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। রোগীর ব্যবস্থাপত্র বা প্রেস্ক্রিপশনে আমরা যে, জী লেখা দেখি এটা মূলত একটা লাতিন শব্দ। যা চিকিৎসক কর্তৃক রোগীর প্রতি কোনো আদেশ ও নিষেধ করাকে নির্দেশ দেয়।
চিকিৎসাব্যবস্থার ক্রম বিকাশের লক্ষ্যে আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং মানুষের জন্য উপযোগী অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। তার এই দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হয়। এই পেনিসিলিন ছিল মানুষের জন্য প্রথম কোনো অ্যান্টিবায়োটিক। যা প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। পরে এই পেনিসিলিন ১৯৪০ সালে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অগণিত যোদ্ধাহত সেনাকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল এই পেনিসিলিন ব্যবহারের মাধ্যমে।
কয়েক দশক আগে থেকেই মানুষের রোগ শনাক্তকরণের জন্য নতুন নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। যা অতি সহজেই মানুষের রোগ চিহ্নিত করতে পারে। বৈশিক জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসের কারণে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপের মতো জটিল রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারণে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে এসব রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
বর্তমানে চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নতি লাভ করেছে। তবে চিকিৎসাব্যবস্থায় ব্যাপক উৎকর্ষতা সত্ত্বেও মানুষ এখনো পশ্চাৎপদ মানুষিকতার কারণে তাবিজ, কবজ, পানিপড়া, গাছ-গাছড়া ব্যবহারের মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকে। এসব চিকিৎসা অপচিকিৎসার শামিল। তাই শরীরের যেকোনো ধরনের অসুস্থতা বোধ করলে অতিসত্তর অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়।
লেখক : তথ্য অফিসার
পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড
"