বেনজীর আহমেদ সিদ্দিকী

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২

পুরান ঢাকার অলিগলির খেতাপুরি!

খেতাপুরি! এ কেমন নাম! এর সঙ্গে কাঁথার কি কোনো যোগসূত্র আছে বা এ নামই এলো কেমন করে? এমন ভাবনা মাথায় নিয়ে পুরান ঢাকার লালবাগের চৌধুরী বাজার মোড়ে গড়ে ওঠা এক ঐতিহ্যবাহী খেতাপুরির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বড় তাওয়ার ওপর বেশ পুরুত্বওয়ালা পুরি হালকা তেলে ভাজা হচ্ছে, নাকে এসে লাগছে তার সুঘ্রাণ। পুরি বিক্রেতা চাচা তার হাতের জাদুতে দ্রুতলয়ে পুরি ভাজতে ভাজতে জানালেন, খেতাপুরির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো অন্যান্য পুরিতে আটা ব্যবহার করলেও এটা বানাতে ময়দা ব্যবহার করা হয়। ময়দার ডো থেকে ছোট ছোট রুটি বেলে তৈরি করা হয়। এভাবে অনেক রুটি তৈরি হলে একটি রুটির ওপর ডাল ঠেসে দিয়ে তার ওপর আরেকটি রুটির টুকরো দিয়ে আবার রুটি বানানো হয়। রুটির পুরুত্ব বেশ মোটা হয়। বুট, খেসারি বা মশুর ডালের সঙ্গে পুদিনা পাতা, ধনিয়া পাতা, কাঁচামরিচ কুঁচি, আদা-পেঁয়াজ-রসুন বাটা ও বিভিন্ন মশলা দিয়ে মিশ্রণ বানানো হয়। যা মূলত খেতাপুরির পুর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পুর যত ভালো হবে খেতাপুরি তত মজা হবে। এরপর হালকা তেলে তাওয়ায় ভেজে তৈরি করা হয় খেতাপুরি।

কথা প্রসঙ্গে আরো জানা গেল, অনেক জায়গায় খেতাপুরি না ভেজে শুধু তাওয়ায় সেঁকে পরিবেশন করা হয়। যারা তেলে ভাজা খাবার পছন্দ করে না তাদের জন্য এটি বেশ উপাদেয়। তাই অনেকে একে ডাল রুটি বলে থাকেন। গড়ে চার থেকে পাঁচ মিনিট সময় লাগে একে গরম করতে। এর দুই পিঠে একটু সেঁক লাগলেই সরিয়ে রাখা হয় তাওয়ার মাঝের গরম অংশ থেকে, মানে এটি ততক্ষণে বিক্রয়ের জন্য তৈরি। এটি গরম গরম খেতে আসলেই অসাধারণ লাগে। খাওয়ার জন্য খেতাপুরির সঙ্গে দেওয়া হয় পুদিনা-ধনিয়া-লেবু-তেঁতুলের চাটনিসহ বিভিন্ন রকম ভর্তা।

ঠিক কখন থেকে খেতাপুরির প্রচলন শুরু হয়েছে বা নামটাই কীভাবে এসেছে এ বিষয়ে অনেককে জিজ্ঞাসা করেও কোনো সদুত্তর পেলাম না। বিভিন্নজন বিভিন্ন কথা বললেও বেশ বয়স্কমতো একজন বিক্রেতা বললেন, খেতাপুরির প্রচলন শুরু হয়েছে সম্ভবত পাকিস্তান আমল থেকে। তবে এটি মূলত উড়িশা, বিহার অঞ্চল থেকে এসে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অনেকটা অর্থনৈতিক কারণে এই খাবারের উদ্ভব। যেহেতু খুবই সহজলভ্য উপাদানে তৈরি, তাই এটি অল্প খরচে প্রয়োজনীয় শর্করা এবং আমিষের অভাব পূরণ করে। তবে তৎকালীন ঢাকার ধনিক শ্রেণির লোকেরা খেতাপুরি খাসি, গরু, মুরগির মাংসের সঙ্গে খেত।

পুরান ঢাকার অলিগলিতে হাঁটার সময় খেতাপুরির দোকান চোখে পড়বেই। দেখতে খুবই সাধারণ মনে হলেও এসব দোকানগুলো বেশ ঐতিহ্যবাহী। অতি সাধারণ এসব দোকানের খেতাপুরি কিন্তু যুগ যুগ ধরে সুনামের সঙ্গে ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। কয়েক পুরুষ ধরে কারিগররা বেশ আগ্রহ নিয়ে এই পুরি বানিয়ে আসছেন। এসব দোকানের খেতাপুরির স্বাদও অসাধারণ। তাই পুরান ঢাকার খেতাপুরির ঘ্রাণ একবার নাকে গেলে স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছা দমন করা কঠিন। এসব দোকানে প্রতিদিন বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে শুরু করে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে খেতাপুরি বিক্রি। আকার ও দোকানভেদে প্রতিটি খেতাপুরির মূল্য তিন বা পাঁচণ্ডদশ টাকা। প্রতিদিন বিকালে প্রতিটি দোকানে গড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ খেতাপুরি বিক্রি হয়। বিকাল বা সন্ধ্যার নাশতায় অনেকেই পুরি পছন্দ করেন। তাই পুরিপ্রেমীদের রসনা মেটাতে পুরান ঢাকার খেতাপুরির জুড়ি মেলা ভার। আর তাইতো খেতাপুরি খেতে স্থানীয় লোকজনসহ আশপাশের অনেকেই প্রতিদিন ভিড় জমান পুরান ঢাকার অলিগলিতে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close