এস এ এইচ ওয়ালিউল্লাহ

  ২৫ জুলাই, ২০২২

ডাকটিকিটে বাংলাদেশের অভ্যুদয়

বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ংকর ও বিভীষিকাময় রাত্রি হচ্ছে ২৫ মার্চ। একাত্তরের অগ্নিঝরা এ রাতে বাঙালি জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের ভয়াল ও নৃশংসতম বর্বরতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তানি দানবরা মেতে উঠেছিল নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালি নিধনযজ্ঞে। এই রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃৃক নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন সেক্টরে তখন যুদ্ধ চলছে পুরোদমে। দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল দশা। সরকারি চিঠিপত্র আদান-প্রদান এবং মুক্তিযুদ্ধের খবর বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে মুজিবনগর সরকার যুদ্ধকালীন ডাক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। সরকার মুক্তাঞ্চলের তৎকালীন পোস্ট অফিসগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফিল্ড পোস্ট অফিস স্থাপন করে এগুলো পরিচালনার ভার অর্পণ করে পরিবহন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ওপর। সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণাকারী বাংলাদেশের তখন নিজস্ব কোনো ডাকটিকিট ছিল না। পাকিস্তানি ডাকটিকিটের ওপর রাবার স্ট্যাম্পের সাহায্যে বাংলা ও ইংরেজিতে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটির সিল লাগিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছিল।

এ পটভূমিকায় সাবেক ব্রিটিশ সাংসদ এবং পোস্ট মাস্টার জেনারেল জন স্টোনহাউস শরণার্থীদের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে ভারতে যান এবং বাংলাদেশি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে মুজিবনগর আসেন। সেই সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে ডাকটিকিট প্রকাশের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে স্বাধীন বাংলার অস্তিত্ব জানান দেওয়ার প্রস্তাব করেন। মন্ত্রী পরিষদে আলোচনা করে তাজউদ্দীন আহমদ স্টোনহাউসকে মুজিবনগর সরকারের সিলমোহর সংবলিত অনুমতি পত্রের অনুলিপির মাধ্যমে ডাকটিকিট প্রকাশের অনুমতি এবং দায়িত্ব প্রদান করেন। দায়িত্ব পেয়ে স্টোনহাউস ব্রিটেনে ফিরে গিয়ে লন্ডন প্রবাসী ভারতীয় বাঙালি নাগরিক বিমান মল্লিক কে বাংলাদেশের জন্য ডাকটিকিট নকশার অনুরোধ জানান। স্টোনহাউসের অনুরোধেই বিমান মল্লিক বিনা পারিশ্রমিকে বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিটের নকশা করেন।

এসব ডাকটিকিটে তিনি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের পরিচয়, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকাণ্ড, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ঐক্যবদ্ধ হওয়া, মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল, ১০ এপ্রিল সরকার গঠনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের শিকল ভাঙা, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং সদ্য স্বাধীনতা ঘোষণাকারী দেশটির পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান জানানোর বিষয়গুলো দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেন।

১৯৭১ সালের ১৮ মে আটটি ডাকটিকিটের খসড়া মি. মল্লিক জন স্টোনহাউস ও তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের ব্রিটেন বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে দেখান। তাদের দুজনেরই মনপুত হয় নকশা। পরে ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ কলকাতায় গিয়ে মুজিবনগর সরকারের থেকে মূল নকশায় অনুমোদন নেন। তারপর লন্ডনের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রেস থেকে ছাপা হয় ডাকটিকিটগুলো। ছাপা হওয়ার পর ২৬ জুলাই তারিখে লন্ডনের হাউস অব কমন্সের ৮নং কমিটি রুমে আন্তর্জাতিক এক সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডাকটিকিটগুলো এবং ফার্স্ট ডে কাভার প্রদর্শন করেন। ২৯ জুলাই একযোগে ডাকটিকিটগুলো লন্ডন ছাড়াও কলকাতা বাংলাদেশ মিশনে, মুজিবনগর, বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলসহ উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকাশিত হয়। সারা বিশ্বে ডাকটিকিটের মাধ্যমে নতুনরূপে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে দিনটিতে। ডাকটিকিটগুলো যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে পৌঁছায় তখন পাকিস্তান আন্তর্জাতিক পোস্টাল ইউনিয়নের সদর দপ্তরে ডাকটিকিটগুলোর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আটকাতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পাকিস্তান সরকারের সেই অভিযোগ গৃহীত না হয়ে উল্টো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত জোরালো হতে থাকে। পাকিস্তানিদের নির্মম নির্যাতনের নিখাদ সত্য বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগোচর হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব জানান দেওয়ায় সেদিন বড় ভূমিকা পালন করেছিল ডাকটিকিটগুলো।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close