মোশতাক আহমেদ তাহসিন

  ০৬ জুন, ২০২২

বেড়ানো

হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত নুহাশ পল্লী

বাংলাদেশের নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিবিজড়িত এক অনিন্দ্য সুন্দর স্থান গাজীপুরের নুহাশ পল্লী। এটি মূলত একটি বাগানবাড়ি। গাজীপুরের হোতাপাড়ায় পিরুজালি গ্রামে ১৯৯৭ সালে হুমায়ূন আহমেদ নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় ৪০ বিঘা জমির ওপর তৈরি করেন এই বাগানবাড়ি। বড় ছেলে নুহাশ হুমায়ূনের নামানুসারে বাগানবাড়িটির নাম রাখেন ‘নুহাশ পল্লী’। দুর্গম জনমানবহীন জঙ্গলের মাঝে এ যেন এক বিশাল নন্দনকানন। প্রায় ৩০০ প্রজাতির ভেষজ, বনজ ও নানা বিরল প্রজাতির গাছের বিশাল সমাহারে হুমায়ূন আহমেদ নুহাশ পল্লীকে পরিণত করেছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমিতে। ঢাকায় বিলাসবহুল বাড়ি থাকা সত্ত্বেও হুমায়ূন আহমেদ শেষ জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন নিজের হাতে গড়া স্বপ্নের নন্দনকানন নুহাশ পল্লীতে। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই কখনো পরিবার, কখনোবা বন্ধুদের নিয়ে নগরের কোলাহলমুখর পরিবেশ ছেড়ে চলে যেতেন নুহাশ পল্লীতে। মূলত নুহাশ চলচ্চিত্রের শুটিং স্পট হিসেবে এ বাগানবাড়ি দর্শনার্থীদের কাছে বেশি পরিচিত। হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ৯ নম্বর বিপদসংকেত, বৃক্ষমানব, গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেডসহ অসংখ্য কালজয়ী নাটকের দৃশ্যধারণ করা হয়েছে এই নুহাশ পল্লীতে। শুরু থেকেই নুহাশ পল্লী ছিল পর্যটকদের জন্য একটি আগ্রহের জায়গা।

ঢাকা থেকে নেত্রকোনা বা ময়মনসিংহগামী বাসে করে হোতাপাড়া, সেখান থেকে ৮ কিলোমিটার ভেতরে পিরুজালী গ্রামে অবস্থান নুহাশ পল্লীর।

নুহাশ পল্লীতে ঢুকতেই চোখে পড়ে সবুজ ঘাসের চাদরে ঢাকা বিস্তৃত মাঠ। মাঠের মাঝখানে রয়েছে একটি পুরোনো লিচুগাছ। সেই লিচুগাছের ওপরে নির্মাণ করা হয়েছে দুটি কুটির, যার নাম দেওয়া হয়েছে ট্রি-হাউস। লিচুগাছের কাছে রয়েছে একটি দাবা খেলার ঘর, সেখানে রয়েছে কাঠ দিয়ে নির্মিত দাবার গুঁটির প্রতিকৃতি। পল্লীতে ঢুকতেই হাতের ডানপাশে রয়েছে অর্গানিকশৈলীতে নকশা করা একটি আকর্ষণীয় সুইমিং পুল, যেখানে হুমায়ূন আহমেদ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একসঙ্গে নেমেছিলেন। সুইমিং পুলের পাশে রয়েছে মা-ছেলে ভাস্কর্য। নুহাশ পল্লীতে বেশ কয়েকটি বাংলো বাড়ি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শনসংবলিত একটি অত্যাধুনিক বাড়ি অন্যতম। যেটির নাম ‘বৃষ্টিবিলাস’। জানা যায়, হুমায়ূন আহমেদ যখন তার সাধের নুহাশ পল্লীতে যেতেন, তখন তিনি ওই বাড়িতেই থাকতেন। বাড়ির নামটি পর্যটকদের বেশি আকৃষ্ট করে। কারণ যথেষ্ট টাকা থাকা সত্ত্বেও হুমায়ূন আহমেদ শুধু বর্ষাকালে ঘরে থেকে বৃষ্টির শব্দ শোনার জন্য টিনের চালা দিয়ে নির্মাণ করেন এই আকর্ষণীয় বাড়িটি। এ ছাড়া নুহাশ পল্লীতে রয়েছে একটি নামাজঘর, প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডাইনোসরসহ বিভিন্ন প্রাণীর মূর্তি এবং হুমায়ূন আহমেদের একটি আবক্ষ ভাস্কর্য। এসব মূর্তির পাশেই চোখে পড়বে

নয়নাভিরাম ছোট একটি পদ্মপুকুর। যেটির মাঝখানে রয়েছে পাথরের কারুকার্য করা একটি মৎস্যকন্যা। পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য পদ্মপুকুরের পাশেই উঁচু ঢিবির ওপর নির্মাণ করা হয়েছে ভয়ংকর রাক্ষসের মূর্তি। রয়েছে পাথরের শান-বাঁধানো লীলাবতি দিঘি, যেখানে লেখা রয়েছে কবিগুরুর বিখ্যাত গানের চরণ ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছো নয়নে নয়নে।’

দিঘিটির দিকে মুখ ফিরিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি আকর্ষণীয়

বাংলোবাড়ি। হুমায়ূন আহমেদ সেই বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ভূতবিলাস। লীলাবতী দিঘির মাঝখানে রয়েছে একটি ছোট দ্বীপ, যেখানে রয়েছে আকর্ষণীয় কিছু নারিকেল গাছ। দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য নির্মাণ করা হয়েছে একটি আকর্ষণীয় ছোট কাঠের সাঁকো। তবে বর্তমানে অযত্নে-অবহেলায় ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে সেই সাঁকোটি। যার কারণে পর্যটকরা দূর থেকেই দ্বীপটির সৌন্দর্য উপভোগ করেন। তা ছাড়াও শুধু শুটিংয়ের জন্য হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেছিলেন টিনের চালাসংবলিত একটি মাটির ঘর।

এ ছাড়াও নুহাশ পল্লীর আমবাগান, লিচুবাগান, খেজুরবাগানের সারি সারি খেজুরগাছ পর্যটকদের আকর্ষণ করে। মাঠের এক কোণে মাটি থেকে প্রায় দশ ফুট ওপরে নির্মাণ করা হয়েছে একটি ছোট পাখির খামার। যেখানে বিভিন্ন প্রজাতির কবুতরসহ রয়েছে অসংখ্য পাখি। এ ছাড়া নুহাশ পল্লীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে বাচ্চাদের খেলাধুলার অসংখ্য সামগ্রী। ২০১২ সালে হুমায়ূন আহমেদ মারা গেলে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় তার নিজ হাতে নির্মিত স্বপ্নের নন্দনকানন নুহাশ পল্লীতেই। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক নুহাশ পল্লী ভ্রমণে যায়। ১২ বছরের বয়সের ওপরের যেকোনো দর্শনার্থী মাত্র ২০০ টাকা টিকিট দিয়ে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৮টা পর্যন্ত নুহাশ পল্লী ঘুরে দেখতে পারবে। তবে হুমায়ূন আহমেদের কবর জিয়ারত করার জন্য সেখানে যেতে চাইলে কোনো টিকিট ছাড়াই নুহাশ পল্লীর বিশেষ ফটক দিয়ে কবরের কাছে যেতে পারবে। এ ছাড়াও ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মবার্ষিকী এবং ১৯ জুলাই মৃত্যুবার্ষিকীতে নুহাশ পল্লী সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। স্থানীয়দের মতে, প্রায় জনমানবহীন দুর্গম এই গ্রামে নুহাশ পল্লীর মতো একটা দর্শনীয় স্থান হওয়ায় এলাকায় মানুষের আনাগোনা যেমন বেড়েছে, তেমনি উন্নতি হচ্ছে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার। নুহাশ পল্লীর আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো, স্থানীয়দের উদ্যোগে মূল ফটকের সামনেই করা হয়েছে ঘোড়ায় চড়ার ব্যবস্থা। স্বল্প টাকার বিনিময় দর্শনার্থীরা ঘোড়ায় চড়ার আনন্দ উপভোগ করতে পারবে। যারা দূর থেকে নুহাশ পল্লী ঘুরতে যাবেন, তারা সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার নিয়ে যাবেন। কেননা নুহাশ পল্লীর ভেতরে খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। মূল ফটকের সামনে একটি মাত্র খাবারের হোটেল থাকলেও দাম অনেক বেশি। তবে ঢাকা থেকে স্বল্প খরচে এক দিনের ভ্রমণের জন্য নুহাশ পল্লী একটি আকর্ষণীয় ও উপযুক্ত জায়গা। শহরের কোলাহলমুখর পরিবেশ ছেড়ে প্রকৃতির স্নিগ্ধ শীতল পরশে কিছুটা সময় ব্যয় করতে চাইলে ঘুরে আসুন নুহাশ পল্লী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close