প্রকৌশলী মো. আলীমুজ্জামান চৌধুরী

  ৩০ মে, ২০২২

জলাশয় পুনঃখনন কার্যক্রমের প্রভাব

দেশের করোনা-পরবর্তী প্রভাব মোকাবিলায় পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য উৎপাদন এবং প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা হলো- ‘দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি পতিত না রেখে উৎপাদনশীল কাজে লাগাতে হবে’। উক্ত নির্দেশনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে মৎস্য অধিদপ্তরের চলমান ‘জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি শীর্ষক’ প্রকল্পটি অক্টোবর, ২০১৫ হতে জুন, ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশের ৬১ জেলার ৩৪৯টি উপজেলায় প্রায় ২,৬০০ হেক্টর আয়তনের পতিত/অব্যবহৃত ভরাট হয়ে যাওয়া বিভিন্ন শ্রেণির জলাশয় (পুকুর/দিঘি/মরা নদী/বরোপিট/বিল/হাওর ইত্যাদি) পুনঃখননের মাধ্যমে মৎস্য চাষ উপযোগী সংস্কার করে স্থানীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে প্রযুক্তিনির্ভর মাছ চাষের আওতায় আনা।

প্রকল্পটির প্রধান উদ্দেশ্য দুটি-

ক. বার্ষিক ১০,২৩৪.০০ টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন (প্রায় ৪.০-৫.০ মে. টন/হে./বছর) এবং

খ. ১৮,২০০ জন প্রান্তিক মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি (৭-১০ জন/হে.)।

এ ছাড়াও অব্যবহৃত জলজসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, সরকারি খাস জলাশয়ে প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, মাছের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ফলে জলাশয়ের ইজারা মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জনসাধারণের চলাচলের রাস্তা, ভূপৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিতে সেচ সুবিধা সম্প্রসারণসহ অনেক লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রকল্পটি গৃহীত। উন্নয়নকৃত জলাশয়ের পাড়/বাঁধগুলোতে শাকসবজি, নেপিয়ার ঘাস ও ফলদ বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

গত এপ্রিল-২০২২ পর্যন্ত প্রায় ২,৪০০ হেক্টর জলাশয় পুনঃখনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে (৯৩.০ শতাংশ) এবং সংস্কারকৃত উক্ত জলাশয় হতে বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ১০,৬০০ টন অতিরিক্ত মাছ উৎপাদনসহ (৪.০-৫.০ মে.টন/হে./বছর) এবং প্রায় ১৬,৮০০ জন প্রান্তিক মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে (৭ হতে ৮ জন/হে.)। এ ছাড়াও পরোক্ষভাবে আরো দ্বিগুণেরও বেশি পরিমাণ মানুষ আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছে (আইএমইডি রিপোর্ট, জুন/২০২১)। ইতোমধ্যেই চলমান জলাশয় সংস্কার প্রকল্পটি করোনার প্রভাব মোকাবিলায় অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণে দেশে অতিরিক্ত মৎস্য উৎপাদন এবং গ্রামীণ পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক প্রভাব ফেলেছে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার গুরুত্ব অনুধাবন করে করোনা মহামারি মোকাবিলার অংশ হিসেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ নির্দেশনায় এবং মৎস্য অধিদপ্তরের নিবিড় তত্ত্বাবধানে প্রকল্পের মূল লক্ষ্য সামনে রেখে (কর্মসংস্থান সৃষ্টি-প্রতি হেক্টরে ৭-১০ জন ও অতিরিক্ত মৎস্য উৎপাদন-৪ মে.টন/হে./বছর) নির্বাচিত ভরাট হয়ে যাওয়া বিভিন্ন শ্রেণির অবশিষ্ট পতিত জলাশয় পুনঃখনন কাজ মাঠপর্যায়ে এগিয়ে চলছে। দেশের ভয়াবহ করোনা মহামারিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে এ ব্যাপক জলাশয় পুনঃখনন কার্যক্রম বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন সংশ্লিষ্ট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা, সিনিয়র উপজেলা/উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, বিভাগীয় সহকারী প্রকৌশলী, জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলীরা। পুনঃখনন কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে নিবিড় মনিটরিং কাজে নিয়োজিত আছেন ৮ বিভাগের উপপরিচালকরা। এ ছাড়াও কেন্দ্রীয়ভাবে মৎস্য অধিদপ্তর এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ টিম চলমান পুনঃখনন কার্যক্রম পরিদর্শন করছে। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী সরকার কর্তৃক নির্দেশিত প্রতিটি পুনঃখনন কাজের সাক্ষী সংরক্ষণ, অনুমোদিত চূড়ান্ত পরিমাপ কমিটি কর্তৃক সম্পাদিত কাজের হিসাব নিরূপণ এবং গঠিত সুফলভোগী গ্রুপের কাছে পুনঃখননকৃত জলায়শটি মাছ চাষের উদ্দেশ্যে হস্তান্তর কার্যক্রম শতভাগ সার্থকভাবে সম্পন্ন হচ্ছে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রকল্পভুক্ত প্রায় সব পুনঃখনন উপযোগী জলাশয়ের মালিকানা কর্তৃপক্ষ ভূমি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো)। সে কারণেই পুনঃখননের জন্য তাদের অনাপত্তিপত্রের প্রয়োজন হয়। মৎস্য অধিদপ্তরের এ ব্যাপক পুনঃখনন কার্যক্রমে করোনা মোকাবিলার অংশীদার হিসেবে জেলা/উপজেলা প্রশাসন এবং বাপাউবো কর্তৃপক্ষের সহায়তা ছিল অত্যন্ত আন্তরিক।

সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় সংস্কারকৃত জলাশয়গুলোর উৎপাদনশীলতা প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ইজারা মূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের রাজস্ব আয় আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে, জনসাধারণের চলাচলের রাস্তা তৈরি হয়েছে, পরিবেশের উন্নয়নসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষা হয়েছে। এ ছাড়াও প্রভাবশালীদের মাধ্যমে বেহাত হওয়া সরকারি সম্পদ পুনরুদ্ধার হয়েছে, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হয়েছে। সর্বোপরি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সরকারি সম্পদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানসহ আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।

সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত জলাশয় সংস্কার প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাপকভিত্তিক জলাশয় পুনঃখনন কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত অগ্রগতি ৯৬ শতাংশের অধিক। ফলে এ পর্যন্ত উন্নয়নকৃত জলাশয় হতে বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক বেশি অতিরিক্ত মাছ উৎপাদন এবং গ্রামীণ মানুষের সরাসরি স্থায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিসহ প্রায় সমপরিমাণ মানুষের পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পটির আরো কয়েকটি সফল দিক হলো- গঠিত সুফলভোগী গ্রুপের সদস্যদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য মৎস্য চাষের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান এবং উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির আওতায় সংস্কারকৃত জলাশয়ে প্রদর্শনী মৎস্য খামার স্থাপন, পানি সেচের পাম্প ও মাছ ধরার জাল বিতরণ। মৎস্য চাষের আধুনিক কলাকৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রদর্শনী স্থাপনের মাধ্যমে উৎপাদনের ফলাফল প্রদর্শন প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে (৫.০ মে.টন/হে./বছর-এর বেশি হয়েছে, আইএমইডি মনিটরিং রিপোর্ট, জুন/২০২১)।

উল্লেখ্য, প্রকল্পের মধ্যবর্তী মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাস্তবায়িত কার্যক্রমের ওপর অনেক ইতিবাচক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এবং দেশব্যাপী বৃহত্তর পরিসরে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত মৎস্য উৎপাদন ও গ্রামীণ পর্যায়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ভরাট জলাশয় পুনঃখননের মাধ্যমে মৎস্য চাষের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি কর্তৃক নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা প্রতিবেদনে সংস্কারকৃত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ৪.০-৬.০ মে.টন/হে./বছর এবং ১৫,০০০-২০,০০০ জনমানুষের সরাসরি গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ সমপরিমাণ মানুষের পরোক্ষ কর্মসংস্থানের ফলে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে বলে মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে। চলমান কার্যক্রমের সফলতা বিবেচনা করে প্রকল্পটির ব্যাপকভিত্তিকি চাহিদা থাকায় মৎস্য অধিদপ্তর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় দেশব্যাপী বৃহত্তর পরিসরে এ ধরনের প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় গ্রহণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক

জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প

মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close