ড. জগৎ চাঁদ মালাকার
তেলজাতীয় ফসলের গুরুত্ব
মানুষ বাড়ছে, জমি কমছে। সেজন্য ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির চাপ আমাদের রয়েছে। ফলে অল্প জমিতে অধিক ফসল ফলানোর তাগিদও বাড়ছে। লক্ষ্য হচ্ছে এক জমি থেকে বছরে তিন ফসল ফলানো। আর এজন্য এমন সব ফসলের জাত প্রয়োজন যেন জমি প্রস্তুতের সময় ছাড়া বাকি সময় তিনটি ফসল কেটে নিয়ে আসা যায়। অনেক শস্যবিন্যাসে, যেমন সরিষা-বোরো-রোপা আমনে তিনটি ফসলের জাত এমনভাবে নির্বাচন করতে হবে, যেন ৩২০-৩৪৫ দিনের মধ্যে তিনটি ফসলই সংগ্রহ করা যায়। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, মানবদেহে দৈনিক প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৩০ শতাংশ তেল বা চর্বিজাতীয় খাদ্য থেকে আসা উচিত, কিন্তু আমাদের আসে মাত্র ৯ শতাংশ, যা নিতান্তই অপ্রতুল। আমাদের ভোজ্য তেলের আমদানিনির্ভরতা কমাতে হবে এবং তা সম্ভব তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। ভোজ্য তেলের জন্য বছরে আমাদের প্রায় ২৪-২৭ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। এর সিংহভাগ খরচ হয় পামঅয়েল ও সয়াবিন তেল আমদানি করতে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় হলো আমদের দেশের কৃষি-পরিবেশ উপযোগী তেল উৎপাদনকারী তেলবীজ ফসল, যেমন-সরিষা, তিল, তিসি, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি করা। ধান যেহেতু বৃষকদের প্রধান ফসল, তাই কৃষক সাধারণত চায় না ধানের ফলন কমে যাক, বরং মাঝখানে একটি বাড়তি ফসল পেতে চান কৃষক। ফলে কৃষকরা স্বল্পমেয়াদি কিন্তু অধিক ফলনশীল জাত পছন্দ করেন। ধানের স্বল্পমেয়াদি আমন ধানের চাষ করা, বিনা ধান-৭, ১৬-ব্রি ধান-৩৩, ৩৯, ৪৯, ৫৬, ৫৭, ৭১, ৭৫ ব্রি হাইব্র্রিড ধান ৪ বাউ ধান-১ ও বোরো ধানের জাত যথাযথভাবে চাষাবাদ করতে পারলে ফলন খুব একটা না কমিয়ে ২৩০-২৫০ দিনের মধ্যে দুটি ধান ফসল সহজে সংগ্রহ করা সম্ভব। কৃষকের কাছে সে রকম জাতের তথ্য পৌঁছে দেওয়া এবং শস্যবিন্যাসে এদের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। আর সেটা পারলে দুই ধানের মাঝখানে ৮০-৯০ দিনের উচ্চফলনশীল সরিষার জাত বারি সরিষা-১৪, ১৫, ১৭, বিনা সরিষা-৯, বাউ সরিষা-১, ২, ৩ আবাদ করা সম্ভব। যেসব জমিতে আউশ বা পাট আবাদ করা হয়; সেসব জমিতে সরিষা চাষের জন্য বারি সরিষা-১৮ (ক্যানোলা টাইপ) নির্বাচন করা যেতে পারে। কারণ ওই জাতের জীবনকাল ও ফলন বেশি।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এ দেশে তেল ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। এই জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। সামগ্রিকভাবে একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নির্ভর করে, সে দেশের মোট খাদ্যের প্রাপ্য, জনগণের খাদ্য ক্রয়ক্ষমতা এবং খাবার গ্রহণের ওপর (সুষম বণ্টন)। তা ছাড়া প্রাপ্য থাকলেও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে জনগণ কিনতে পারবে না। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য চাহিদার ৫৩ শতাংশ আমরা পাই দানাদার খাদ্যশস্য থেকে, যা দৈনিক ২১২২ কিলোক্যালরির ৭৫ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ কিলোক্যালরি আসে ফলমূল, শাকসবজি, ডাল ও তেল থেকে। মাথাপিছু তেল গ্রহণের চাহিদা ৩০ গ্রাম, আমরা গ্রহণ করি ২০-২২ গ্রাম। খাদ্য ও পুষ্টি দুটি বিষয় খুবই অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। আমরা খাদ্য খাই দেহের পুষ্টির জন্য। খাদ্য গ্রহণের ফলে দেহে পুষ্টি উপাদান শোষিত হয় এবং দেহের পুষ্টি সাধন ঘটে। ভালোভাবে জীবনধারণের জন্য আমাদের পুষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান খুবই জরুরি একটি বিষয়। দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব হলে দেহে নানা সমস্যা তৈরি হয়। আমাদের মতো দরিদ্র দেশে পুষ্টি সমস্যা একটি মারাত্মক সমস্যা। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের পুষ্টি সমস্যা খুবই প্রকট। অনেকেই পুষ্টি উপাদান, তার উৎস, অপুষ্টিজনিত সমস্য ও তার প্রতিকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই।
স্নেহ পদার্থ-আমিষের মতো প্রাণী এবং উদ্ভিদ দুই উৎস থেকেই স্নেহ পদার্থ পাওয়া যায়। যেমন ঘি, মাখন, চর্বিযুক্ত মাংস, চর্বিযুক্ত মাছ ইত্যাদি প্রাণী থেকে এবং সরিষার তেল, তিলের তেল, বাদামের তেল, সয়াবিনের তেল ইত্যাদি উদ্ভিদ থেকে পাওয়া যায়।
কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী গ্রামে বসবাস করে, যারা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নানামুখী উৎপাদনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এ খাতের সফলতা প্রধান সামষ্টিক অর্থনৈতিক উপাদানগুলো, যেমন- কর্মসংস্থান সৃজন, দারিদ্র্যবিমোচন, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে। প্রচলিত শস্যবিন্যাসে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রমাণিত স্বল্পমেয়াদি তেল ফসলের আধুনিক জাত অন্তর্ভুক্ত করে বর্তমান তেল ফসলের (সরিষা, তিল, সূর্যমুখী, চীনাবাদাম ও সয়াবিন) আবাদি এলাকা ৭.২৪ লাখ হেক্টর থেকে ১৫-২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
বিএআরআই ও বিনা কর্তৃক উদ্ভাবিত তেল ফসলের আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রসারণ এবং মৌচাষ অন্তর্ভুক্ত করে তেলজাতীয় ফসলের হেক্টরপ্রতি ফলন ১৫-২০ শতাংশ বৃদ্ধি করার বিকল্প নেই। মৌচাষ সম্প্রসারণের ফলে তেল ফসলের পরাগায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি পাবে। তা ছাড়া উৎপাদিত মধু থেকে বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু ভোজ্য তেল ব্যবহার বাড়বে এবং পুষ্টি ঘাটতি পূরণ হবে।
বর্তমানে দেশ দানাজাতীয় খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও তৈল, চর্বি ও প্রোটিনের পুষ্টিসমৃদ্ধ শস্য বিশেষভাবে তেলজাতীয় ফসল উৎপাদনে অনেকটাই পিছিয়ে আছে, যা টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০-এর পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা, সেটি অর্জনের একটি প্রধান অন্তরায়। এ কথা অনস্বীকার্য, গুণগত মানসম্পন্ন পরিমিত ভোজ্য তেল খাওয়া ব্যতিরেকে পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব নয়, কারণ ভোজ্য তেলে রয়েছে অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাটি অ্যাসিড, যা মানবদেহে তৈরি হয় না। এ ঘাটতি পূরণে ভোজ্য তেল সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সেজন্য দেহকে সুস্থ, সুগঠিত ও রোগ প্রতিরোধে কার্যকর রাখতে নিয়মিত সঠিক পরিমাণ ভালোমানের ভোজ্য তেল গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করতে হবে। জাতির জনকের মহামূল্যবান বাণী অনুসরণ করে সম্মানিত কৃষক ভাইদের তেলজাতীয় ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করে দেশকে তেল সংকট থেকে রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি মানুষের পুষ্টিগুণ বাড়াতে হবে।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি
ঢাকা-১২১৫
"