গাজী শাহাদত হোসেন ফিরোজী

  ২৫ এপ্রিল, ২০২২

গ্রামবাংলার ডুলি-পালকি

ডুলি বহনকারীদের বলা হতো বেহারা- এরা ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু। ডুলি বহন করত দুজন আর পালকি বহন করত চারজন।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে গেছে ডুলি এবং পালকি। অতীতে বিবাহকার্যে ব্যবহৃত হতো এই ডুলি আর পালকি। বেহারাদের কাঁধে বহনকারী ডুলি বা পালকিতে চড়েই বর গমন করত কনের বাবাবাড়িতে। আর ডুলি বা পালকির সঙ্গে আসত গরুর গাড়ি বা পদব্রজে বরযাত্রীরা। তা ছাড়া রাস্তায় বেহারাদের মুখের হু হু না না, হু হু না না, শব্দে ছুটে আসত প্রতিবেশী ছেলেমেয়েরা।

ছোট ছেলেমেয়েরা বরের ডুলি বা পালকি রশি (দড়ি) টাঙিয়ে ঠেকিয়ে আদায় করে নিত পুরস্কার বা নজরানা। যার পরিমাণ ছিল ওই সময়ের দুই আনা থেকে তিন আনা। আর বর ধনাঢ্য হলে ভাগ্যে জুটত চার আনা বা এক সিকি। পালকিতে চড়ে বরের আগমনে তাকে দেখার জন্য ছুটে আসত পাড়া-প্রতিবেশীরা। বরের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে মেয়েপক্ষের নানি-দাদিরা ডুলি-পালকি থেকে নামাত। পরিয়ে দিত গলায় সোনার চেইন অথবা হাতে সোনার আংটি।

বর নামিয়েই বরযাত্রী সবাইকে প্রথমে খেতে দিত ঘ্যাগা নাশতা, যা চাল, গুড় আর দুধ দিয়ে তৈরি। প্রথমে নাশতা পরে অন্যান্য খাবারও পরিবেশন করত। এ সময় প্রথমে বরের মুখে তুলে দেওয়া নাশতা, খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরনের কাপড় দিয়ে খুশি করত কন্যার দাদি-নানিকে। আর বরযাত্রীদের বসার আসন হতো খড়ের ওপর ছালা বিছানো আঙিনায়। শুধু বরকে বসতে দেওয়া হতো কাঁথা বিছিয়ে।

ধর্মীয় বিধিবিধান ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বিবাহ সম্পন্ন হলে অনুরূপভাবে পালকিতে উঠে বসত নববিবাহিতা স্বামী-স্ত্রী। অন্ধ বিশ্বাসকে সামনে রেখে নববিবাহিত স্ত্রীর পরনের কাপড়ের আচলে রসুন, হলুদ, কালিজিরা বেঁধে দেওয়া হতো। যাতে ভূত, প্রেত বা জিনের আচড় না লাগে। এ সময় ব্যতিক্রমধর্মী আনন্দণ্ডফুর্তি থাকত মুরব্বিদের পাশাপাশি ছোটদেরও।

অতীত স্মৃতিচারণ করে ডুলি বহনকারী বেহারা কামারখন্দের জামতৈল গ্রামের বয়োবৃদ্ধ বদন ও শান্তা বলেন, ‘আমাগরে ডুলি-পালকি বহন করার নেইগা খাওয়া-দাওয়া, চাল-ডালসহ দুই থেকে তিন টাকা পারিশ্রমিক দেওয়া অইছে। এহুন এই পালকি আর ডুলি কেউ ব্যবহার করে না। তাই আমি আমার পালকি আজও পাকঘরের টোঙ্গে (মাচায়) তুইলা থুছি।’

সেদিনের সেই বর-কনে বহনকারী ডুলি আর পালকির স্থান দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন বিদেশি উন্নত মানের গাড়ি, বাসসহ আধুনিক যানবাহন। সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের খাদ্যসামগ্রীতেও পরিবর্তন এসেছে। ঘ্যাগা নাশতার পরিবর্তে এসেছে পোলাও, কোরমাসহ উন্নত এবং আধুনিক খাদ্যসামগ্রী। আর খাবার পর হাত পরিষ্কার করার জন্য বেঁধে রাখা গামছার পরিবর্তে এসেছে টিস্যু পেপার।

তাইতো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘পালকি চলে গগন তলে...। আর ভুপেন হাজারিকার গাওয়া ‘দোলা ও দোলা... বড় বড় মানুষের দোলা।’ আজও সেসব স্মৃতিসচেতন মানুষকে নাড়া দেয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close