reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ১১ এপ্রিল, ২০২২

পাঙাল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি

বাংলাদেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে স্বকীয় সত্তা বজায় রেখে সহাবস্থানকারী একমাত্র মুসলিম ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হলো মণিপুরি মুসলিম (পাঙাল)। মূলস্রোতের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস সত্ত্বেও পাঙালরা তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে। এই নিবন্ধে তার কিছু আলোকপাত করছেন শিক্ষক ও লেখক সাজ্জাদুল হক স্বপন

পোশাক-পরিচ্ছদ : ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ও বংশপরম্পরায় ঐতিহ্যবাহী পোশাকের প্রচলন হয়ে আসছে। পাঙালদের আদি পিতা মুসলিম হওয়ার কারণে পুরুষরা বাঙালিদের মতো শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, পাজামা, লুঙ্গি ইত্যাদি পরিধান করেন আর আদি মা মণিপুরি হওয়ার কারণে মণিপুরিদের মতো নিজস্ব তাঁতে তৈরি ফানেক (পরনের কাপড়), খুদাই/ইন্নাফি (ওড়না), ব্লাউজ পরিধান করে থাকেন। অবিবাহিত নারীরা লাই, সালু, হাংগামপাল, সোনারং, চুমহাপ্পা, মাকং ইত্যাদি ফানেক পরে থাকেন। বিবাহিত মহিলারা ভিন্ন রং ও ডিজাইনের- লৈফানেক আরোলবা, মায়ায়রনবি, সালু ফানেক আরোলবা, লৈচিল, হৈরেং আরোলবা, উরেং চুমহাপ্পা ইত্যাদি পরিধান করে থাকেন। কোমরে প্যাঁচানো থাকে খোয়াংনাম্ফি (ছোট কাপড়)। সামাজিক যেকোনো অনুষ্ঠানে ট্রাডিশনাল ড্রেস পরা বাধ্যতামূলক। বিবাহিত মহিলারা এক ধরনের বোরকা ও ছাতা ব্যবহার করেন, যা অন্য সমাজে দৃষ্টিগোচর হয় না। বর্তমানে মহিলারা সালোয়ার-কামিজ, ম্যাক্সি, শাড়ি, বোরকা ইত্যাদিও পরিধান করে থাকেন।

বিবাহ : পাঙাল সম্প্রদায়ের বিবাহরীতি বাঙালি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এ সমাজে ঘটকপ্রথা চালু নেই। বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা কতগুলো পর্যায়ে বিভক্ত থাকে। বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্বের শুরুতেই ছেলেপক্ষের নিকট আত্মীয়রা কনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং একে বলা হয় ‘হায়জাবা কাবা’। এ পর্বে দেনমোহর-সংক্রান্ত কথাবার্তা ঠিক করা হয়। অতঃপর চূড়ান্ত বাগদান পর্বের জন্য অনুষ্ঠিত হয় ‘কাপুবা’ বা পানচিনির ব্যবস্থা। এ পর্বে ফলমূল, মিষ্টি, পান, সুপারি ইত্যাদি নিয়ে বরপক্ষের লোকজন কনের বাড়িতে যায় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে। বিয়ের পূর্বদিন রাতব্যাপী বর-কনের বাড়িতে আলাদাভাবে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এটাকে বলা হয় ‘পুরজাক’। পুরজাক অনুষ্ঠানে কনের পরনে থাকে ‘কমিন’ (বিশেষ ধরনের পোশাক) এবং খেমচি ব্লাউজ ও মাথায় থাকে ব্যতিক্রমী কাজ ও ফুল দিয়ে ঝালর দেওয়া ‘লৈত্রেং’ (গোলাকার)। সঙ্গে পরে ঐতিহ্যবাহী স্বর্ণালঙ্কার। অন্যদিকে বর থাকে স্বাভাবিক সাজে। বর ও কনের উভয় অনুষ্ঠানে রাতব্যাপী চলে ঐতিহ্যবাহী গান। যুবক-যুবতীসহ বিবাহিত লোকজনও গানের উৎসবে মেতে উঠেন এবং সঙ্গে যুক্ত হয় ‘থাবালচোংবা’ (নৃত্য)। যুবক-যুবতীসহ সবাই যৌথভাবে কিংবা আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। পরদিন বর বাঙালির মতো পাজামা, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি ইত্যাদি পরিধান করে বন্ধুবান্ধবসহ পঞ্চায়েতের লোকজন নিয়ে (পঞ্চায়েতের লোকজন বরযাত্রী হিসেবে যাওয়া বাধ্যতামূলক) বরযাত্রীর দল রওনা দেয়। বরযাত্রা করার সময় নিজের মা-বাবা ও মুরব্বিদের সালাম করে ও দোয়া নিয়ে ঐতিহ্যবাহী চাদর ‘কাংথমফিদা’র ওপর পা দিয়ে যাত্রা করার রেওয়াজ রয়েছে। আগে বরযাত্রা করত হাতি, পালকি দিয়ে কিন্তু বর্তমানে কার, লাইটেস নিয়ে কনের বাড়িতে পৌঁছায় এবং

মুরব্বিদের অনুমতি পাওয়ার পর প্রবেশ করে। কনের বাড়ির উঠানে কাংথমফিদায় বরযাত্রীদের বসানো হয়। নিজস্ব ভাষায় বরযাত্রীদের পক্ষ থেকে গান পরিবেশন করা হয়। মহল্লার ইমাম সাহেব ইসলামি তরিকায় কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক বিয়ে পড়ান। তিনজন ‘গাওয়া-উকিল’ (একজন উকিল ও দুজন সাক্ষী) থাকে এবং উকিলের হাতে থাকে একটি লাঠি। বর ও কনে আলাদাভাবে নিচুস্বরে কবুল বলে থাকে এবং গাওয়া-উকিল তার সাক্ষী হয়। ব্রিটিশ পিরিয়ডের পরবর্তীকাল থেকে পাঞ্জাবি, পাজামা ও শেরওয়ানির প্রচলন শুরু হয়েছে। ইদানীং কনের পরনে বাঙালির মতো বিয়ের শাড়ির ব্যবহারও লক্ষ করা যায়। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে বরের পরনে থাকত ধুতি। সেসময় হাতি ও পালকির প্রচলন ছিল, যা বর্তমানে নেই। বিয়ের পর একে অন্যকে দাওয়াত দিয়ে পরিচয় পর্বের আনুষ্ঠানিকতাও রয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী কাঠের বাড়ি : পাঙালদের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি-বিশেষ কারুকাজ, বৈশিষ্ট্য ও নিপুণ কারিগরের এক শৈল্পিক সৃষ্টি। সব বাড়িই কাঠের তৈরি, প্রায় সমান কারুকাজ, ওপরে শন/টিন। পূর্ব-পশ্চিমমুখী বাড়িকে বলা হয় ‘সাংগাই’ এবং উত্তর-দক্ষিণমুখী কিংবা অন্যমুখী বাড়িকে বলা হয় ‘সাংফাই’। প্রতিটি বাড়িতে কমপক্ষে ২১-২২টি খুঁটি (তারেং) থাকে এবং কক্ষগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন- পিবা কা (ছেলের কক্ষ), বাড়ির ডানদিকে নিঙোল কা (মেয়ের কক্ষ), ভেতরে মাইবা কা (মা-বাবার কক্ষ), ফামুং কা (বাসরঘর), সামনের দিকে ফুংগা (রান্নাঘর)। তিন পাওয়া বিশিষ্ট জসবি (অ্যাংগেল) দিয়ে তৈরি বিশেষ ধরনের চুলা থাকে বাড়ির ভেতরে সোজা মূল দরজা বরাবর। এই ঐতিহ্যবাহী বাড়ি আজ অনেকটা অতীত ও বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। কালের সাক্ষী হিসেবে কয়েকটি বাড়ি সংরক্ষিত রয়েছে।

গান : পাঙালদের ঐতিহ্যবাহী গানগুলো হলো- কাসিদা (ফার্সি ভাষা), ইন্দারসাফা (উর্দু ভাষা), খুনুং, খুলং, জাগোই, থাবাল, মারিফত, কাওয়ালি, নাত, গজল, আসেমবা (স্বরচিত) ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী গান। তা ছাড়া ওয়ারি লিবা (গল্পবলা)ও খুবই জনপ্রিয় আইটেম। প্রতিটি গ্রামে কমপক্ষে দু-তিনটি গানের দল থাকত। গানের প্রতিযোগিতা হতো বিয়ের অনুষ্ঠান অথবা অন্য কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে। ছেলে ও মেয়ের উভয় দলে দু-তিনজন সদস্য থাকত এবং পাল্টাপাল্টি গানের প্রতিযোগিতা হতো বিপুল দর্শকের উৎসাহ ও উদ্দীপনায়। গানের প্রতিযোগিতা রাত পার হয়ে ভোর অবধি চলত। পরিশেষে মুরব্বিদের হস্তক্ষেপে প্রতিযোগিতার নিষ্পত্তি হতো। খালি গলায় গান পরিবেশন করা হতো, কোনো যন্ত্রাংশের ব্যবহার ছিল না। পাশ্চাত্য, হিন্দি ও বাংলা গানের প্রভাবে এই গানের আকর্ষণ ধীরে ধীরে কমে আসছে।

খেলাধুলা : পাঙাল সম্প্রদায়ের স্বীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খেলাধুলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- মুক্না (কুস্তি খেলার মতো), কাংজাই (হকি খেলার মতো), কাং ইত্যাদি। মুক্না খেলাটি ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আন্তঃপাঙাল ক্রীড়ার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলা ছিল। খেলা হতো এককভাবে। মুক্না খেলায় পাঙালদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন- মো. ইসলাম (কোনাগাঁও), মো. আবদুর রশিদ খান (পশ্চিম জালালপুর), মো. আবদুল হাই (পশ্চিম কান্দিগাঁও), মৌলানা আমির উদ্দিন (পশ্চিম কান্দিগাঁও) ও মো. আমির উল্লাহ (গোলেরহাওর)। কাংজাই খেলাও জনপ্রিয় ছিল। আজ সময়ের অশান্ত স্রোতে এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় খেলার প্রভাবে এসব খেলা বিলীন হয়ে গেছে।

পাঙাল সম্প্রদায়ের গৌরবময় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা ও বিলুপ্তি থেকে রক্ষার জন্য সামাজিক আন্দোলন এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা খুবই প্রয়োজন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close