দূরে কোথাও
দুটি পাতা একটি কুঁড়ির শ্রীমঙ্গল
শ্রী দাশ ও মঙ্গল দাশ নামে দুজন লোক হাইল-হাওরের তীরে প্রথমে বসতি স্থাপন করেন। এ দুই ভাইয়ের নামানুসারে শ্রীমঙ্গল নামকরণ করা হয়। আরো কথিত আছে শ্রীমঙ্গল শহরের অদূরে মঙ্গল চণ্ডী দেবতার একটি থলি ছিল। তার নামানুসারে শ্রীমঙ্গল নামকরণ করা হয়। পাহাড়, রেইন ফরেস্ট, হাওর আর সবুজ চা বাগান রয়েছে এ অঞ্চলে। এজন্য এ স্থানে প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটকের সমাগম থাকে। আর এ কারণে শ্রীমঙ্গলে গড়ে উঠেছে পাঁচ তারকা হোটেল অনেক আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ।
শ্রীমঙ্গলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে চা বাগান। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ শ্রীমঙ্গল। চা-শিল্পের জন্য শ্রীমঙ্গলের সুনাম ও পরিচিতি বিশ্বব্যাপী। দেশের ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে এ উপজেলায় ৪০টি চা বাগান। এখানে রাবার, লেবু ও আনারসের চাষও হয়। শ্রীমঙ্গলের পাশে অবস্থিত হাইল হাওরের বাইক্কা বিল দেশের বৃহৎ মৎস্য অভয়াশ্রমগুলোর মধ্যে একটি। পাহাড়, অরণ্য, হাওর আর সবুজ চা বাগান ঘেরা নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি শ্রীমঙ্গল। প্রকৃতির সুরম্য নিকেতন শ্রীমঙ্গলে দেখার আছে চা বাগানের পর চা বাগান, চা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ, চা গবেষণা কেন্দ্র, লাউয়াছড়া ইন্সপেকশন বাংলো, খাসিয়াপুঞ্জি, মণিপুরীপাড়া, ডিনস্টন সিমেট্রি, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান নির্মাই শিববাড়ি, টি-রিসোর্ট, ভাড়াউড়া লেক, পাহাড়ি ঝরনা, চারদিকে প্রকৃতির নজরকাড়া সৌন্দর্য আর হাজারো প্রজাতির গাছ-গাছালি। পাহাড় ও ঘন বনাঞ্চল থাকায় শ্রীমঙ্গল বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ও ঠাণ্ডা এলাকার তালিকাভুক্ত। চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে গেলে দেখবেনÑ
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান : পর্যটকদের কাছে শ্রীমঙ্গলের সবচেয়ে বহুল দর্শনীয় স্থান হলো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। প্রতি ১০০ জন পর্যটক শ্রীমঙ্গলে এলে ৭০ জনই এই উদ্যানে নিসর্গ ভ্রমণে যায়। বুনোপথের দুপাশ জুড়ে চোখে পড়বে, কীটপতঙ্গ, নানা রকম গাছপালা, বনের ভেতর দিয়ে ট্রেইলগুলো এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যাতে বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত না হন। জাতীয় উদ্যানটিতে বেশ কিছু পাহাড়ি ছড়াও রয়েছে। পুরো লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট ঘুরে দেখার জন্য ৪ ঘণ্টা সময়ই যথেষ্ট। শীতের মৌসুমে সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থীর পদচারণে থাকে উদ্যানটিতে। প্রকৃতপক্ষে, অরণ্যপ্রেমীদের কাছে, সুন্দরবনের ঠিক পরেই এই উদ্যানের অবস্থান। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পিত বনায়নের ফলেই দেশের এই একমাত্র রেইন ফরেস্টটি গড়ে উঠেছে।
মাধবপুর লেক : টিলার ওপর সুদৃশ্য চা বাগানে ঘেরা স্বচ্ছ পানির এই হ্রদটি ১৯৬৩ সালে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা হয়। হ্রদের দৈর্ঘ্য ৩ কিমি এবং গড় প্রস্থ ১৭৫ মিটার। মাধবপুর লেকে আলাদা প্রবেশ ফি নেই। সিএনজি, চান্দের গাড়ি কিংবা ব্যক্তিগত গাড়ির পার্কিং ও পাস চার্জ নেওয়া হয়, অর্থাৎ, জনে জনে আলাদা করে আবার টিকিট কাটতে হবে না।
শ্রীমঙ্গলের চা বাগান : শ্রীমঙ্গলের কথা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সারিসারি চা বাগান। চা-পাতার সজীবতা কল্পনায় আপনাকে সতেজ করে দেয়। উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা টিলার ওপর অবস্থিত সুদৃশ্য সবুজ চায়ের পত্রপল্লব আপনার মনকে আন্দোলিত করবে। দুটি পাতা এবং একটি কুড়ির দেশ খ্যাত শ্রীমঙ্গল চায়ের জন্য বিখ্যাত। বস্তুত, এজন্যই একে চায়ের রাজধানী বলা হয়। দেশের সবচেয়ে বড় ৩টি চা-বাগানে এখানে অবস্থিত। শ্রীমঙ্গলের কয়েকটি বিখ্যাত চা বাগান হলো-ফিনলে টি এস্টেট, নূরজাহান টি এস্টেট, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইস্পাহানি টি-গার্ডেন।
বাইক্কা বিল : বাইক্কা বিলে না গেলে শ্রীমঙ্গল ঘুরে আসা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। শুনশান নীরবতায় আচ্ছন্ন গাছপালায় আচ্ছাদিত বিলের পড়ন্ত বিকালের সৌন্দর্য আপনাকে কল্পনার জগতে নিয়ে যাবে। জল ও ভূমির অসাধারণ মিতালি এবং একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অতিথি পাখির অভয়াশ্রম সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
হামহাম ঝরনা : আনুমানিক ১৫০ ফুট উচ্চতার এই বুনো জলপ্রপাতের অবস্থান মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুর্গম কুরমা বন বিট এলাকায়। ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতিতে হামহাম ঝরনা মাধবকু- ঝরনার তিন গুণ। ঝরনাটি তার বুনো সৌন্দর্যের ভেলকি দেখিয়ে পর্যটকদের বিমোহিত করে রাখতে পারে। কুমারীসুলভ হামহাম তার নির্ভেজাল যৌবনের আকুতি নিয়ে আপনার অপেক্ষায় বসে আছে।
সাত রঙের চা : রমেশ রাম গৌড় নামের এক ব্যক্তি সর্বপ্রথম এই সাতরঙের চা উদ্ভাবন করেন। নীলকণ্ঠ কেবিন নামে একটি দোকানে উদ্ভাবিত ৭ কালারের চা বিক্রি করতেন। সেখান থেকে এই চা আস্তে আস্তে পুরো সিলেট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, তার স্বত্বে শ্রীমঙ্গলে দুটি চায়ের দোকান রয়েছে। পুরোনো শাখাটির নাম আদি নীলকণ্ঠ টি কেবিন বা নীলকণ্ঠ-১, যা রামনগর মণিপুরী পাড়ায় অবস্থিত এবং নতুন শাখার অবস্থান কালিঘাটের ১৪ বিজিবি ক্যাম্পের পাশে যেটা নীলকণ্ঠ-২ নামে পরিচিত।
লাসুবন গিরিখাদ : লাসুবন গিরিখাদের অবস্থান শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিমি দূরবর্তী ত্রিপুরা সীমান্তের সিন্দুরখান ইউনিয়নের উপকণ্ঠে জঙ্গলঘেরা পাহাড়ি এলাকায়। অমিত সম্ভাবনাময়ী এই দর্শনীয় স্থানটি নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক অভিযাত্রীদের জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্যে পরিণত হতে যাচ্ছে; ধরেই নেওয়া যায়।
রাবার বাগান : দেশে উৎপাদিত রাবারের উল্লেখযোগ্য অংশ আসে সিলেট বিভাগ থেকে। বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন রাবার বাগানের সংখ্যা অগণিত। এর মধ্যে চায়ের রাজধানীতে রয়েছে সাতগাঁও রাবার বাগান। লাউয়াছড়া সড়ক ধরে যাওয়ার পথে এবং চা জাদুঘরে পাশে রাবার বাগান রয়েছে। চা জাদুঘর থেকে রাবার বাগানটি হেঁটেই ঘুরে আসতে পারবেন।
স্বর্ণালি ছড়া : অবস্থান শ্রীমঙ্গলের রাধানগরে। রাধানগর থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে ছোট্ট সেতুর নিচে ছড়াটির অবস্থান। ছড়ার পানি সরু নালা বেয়ে প্রবাহিত হয়। নালার পাশজুড়ে পাথর। পানির এই প্রবাহ সামনের পাথরগুলোর ওপর সবুজ আবরণ সৃষ্টি করে দেখে স্থানীয়রা ছড়াটির নাম দিয়েছে স্বর্ণালি ছড়া। ছড়া দিয়ে অল্প একটু এগোলেই দেখতে পাবেন বাঁশ বাগান। ভাগ্য ভালো থাকলে বাঁশ বাগানের ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজও শুনতে পাবেন। হরেক রকমের বুনো গাছপালাও রয়েছে সেখানে। ছড়ার দুই ধারের বন্য ফুলগুলো সৌন্দর্যের কপালে আরেকটি টিপ এঁকে দেয়। অসাধারণ এই পাহাড়ি ছড়া শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে অটোতে করে যেতে পারবেন।
যাতায়াত : ঢাকা থেকে ট্রেন কিংবা বাসে করে সহজেই শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। ঢাকার ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ ও মহাখালী থেকে হানিফ, শ্যামলী, বিআরটিসি, এনা ইত্যাদি পরিবহনের নন-এসি ও এসি বাস প্রতিদিনই শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে শ্রীমঙ্গলে ট্রেন চলাচল করে।
কোথায় থাকবেন : শ্রীমঙ্গলে থাকার জন্য রয়েছে অসংখ্য মনোরম রিসোর্ট। চা বাগানঘেঁষা গেস্ট হাউস বেসরকারি কটেজ। শ্রীমঙ্গল শহরে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আবাসিক হোটেল। এ ছাড়া লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের খুব কাছে রয়েছে গ্র্যান্ড সুলতান টি-রিসোর্ট। বিভিন্ন
মানের হোটেল রিসোর্ট পেয়ে যাবেন খুব সহজেই।
লেখা ও ছবি : এস এম আরিফুল আমিন
"