অলোক আচার্য

  ২২ নভেম্বর, ২০২১

দূরে কোথাও

কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুর কাচারিবাড়ি

বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে/দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা/দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/একটি ধানের শিষের উপরে/একটি শিশিরবিন্দু।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘একটি শিশির বিন্দু’ শীর্ষক এই কবিতাটিতে আমাদের হাতের মুঠোয় থাকা সৌন্দযর্, যা অবহেলায় দেখা হয় না অথবা কাছে আছে ঠিক কিন্তু ঘুরে দেখা হয় না, সেই না দেখা সৌন্দর্যকেই বুঝিয়েছেন।

এমন একটি জায়গায় আমারও এত দিন যাওয়া হয়নি অথচ যা ছিল হাতের কাছেই। সেটি কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে অবস্থিত যা ‘কুঠিবাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। শাহজাদপুর বাসস্ট্যান্ডে নেমে কুঠিবাড়ির কথা বললেই রিকশা বা ভ্যানে কয়েক মিনিটেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। মূল গেটের বাইরে থেকেই চোখে পরবে দ্বিতল ভবন। যদিও সেটি কাচারিবাড়ি বললেই ঠিক হয়। টিকিট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি হলো। শরীরজুড়ে খেলে গেল এক অপূর্ব শিহরন। এখানেই এক দিন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসতেন, চলাফেরা করতেন এবং তার সাহিত্য রচনা করতেন। ভাবতেই অন্যরকম লাগল।

চারদিকে অসংখ্য ফুলগাছ। সবকিছুই আছে শুধু কবি নেই। কবির ব্যবহৃত কাচারিবাড়ির দিকে তাকালেই যেন মনে হয় কবি আছেন, তাকিয়ে আছেন দর্শনার্থীদের দিকে। ভবনের প্রবেশমুখেই পর্যটকদের জন্য কাচারিবাড়ির ইতিহাসসংবলিত লেখা টানানো রয়েছে। সেখান থেকে জানা যায়, তিন তৌজির অন্তর্গত ডিহি শাহজাদপুরের জমিদারি একদা নাটোরের রানি ভবানীর জমিদারির একটি অংশ ছিল। ইংরেজি ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর মাত্র ১৩ টাকা ১০ আনায় এই জমিদারি কিনে নেন। জমিদারির সঙ্গে সঙ্গে শাহজাদপুরের কাচারিবাড়িটিও ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিল বলেই ধারণা করা হয়। এর আগে এ বাড়ির মালিক ছিল নীলকর সাহেবরা। ১৮৯০ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত মাত্র আট বছর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানকার জমিদারি দেখাশোনার কাজে মাঝে মাঝে আসতেন এবং সাময়িকভাবে বসবাস করতেন। তিনি স্থায়ীভাবে থাকতেন শিলাইদহে। শাহজাদপুরের কাচারিবাড়ি ইন্দো-ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত একটি দ্বিতল ভবন। ভবনটির দৈর্ঘ্য ২৬ দশমিক ৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০ দশমিক ২০ মিটার এবং উচ্চতায় ৮ দশমিক ৭৪ মিটার। টিকিট নিয়ে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করলাম। নিচতলার প্রতিটি কক্ষেই রয়েছে কবিগুরুর বিভিন্ন সময়ের ছবি, তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তোলা স্মৃতি, কবির হাতে আঁকা ছবি, নিজ হাতে লেখা চিঠি এবং একটি কক্ষ মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। এবার পেঁচানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলাম। সেখানে প্রতিটি কক্ষে রয়েছে কবির কক্ষে ব্যবহৃত সামগ্রী। প্রথম কক্ষেই রয়েছে পালকি এবং কবির ব্যবহৃত বজরার একটি প্রতিকৃতি। এ ছাড়াও বাকি সব কক্ষে রয়েছে আলনা, কাঠের বড় টেবিল, হাতলযুক্ত চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল (কাঁচ ভাঙা), চিনামাটির ছাঁকনি, শ্বেত পাথরের গোল টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, টেবিল বেসিন সেট, দেবতার আসন, সোফা, ল্যাম্পস্ট্যান্ড, খাট, গ্লাস, টব, ঘটি, ফুলদানি, সাবানদানি, দেয়ালঘড়ি ইত্যাদিসহ কবির ব্যবহৃত বহু জিনিস। উভয় পাশে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। সামনে দাঁড়ালেই এক নজরেই পুরো কাচারিবাড়ি দেখা যায়। এখানে কবির বহু বিখ্যাত লেখা রচিত হয়েছে। এখানেই সোনার তরীর- বৈষ্ণব কবিতা, দুই পাখী, আকাশের চাঁদ, চিত্রা কাব্যের চিত্রা, শীতে ও বসন্তে, নদীযাত্রা, মৃত্যু মাধুরী, প্রথম চুম্বন, শেষ চুম্বন, প্রেয়সী, বিদায়, ইছামতি নদীসহ পোস্ট মাস্টারের মতো বিখ্যাত গল্প এবং ছুটি, সমাপ্তি, ক্ষুধিত পাষাণ, অতিথি, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, ব্যবধান গল্প লিখেছেন। সেই সঙ্গে ৩৮টি পত্র এবং নাটক লিখেছেন। তখন মনে পরে গেল ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের কথা, পোস্ট মাস্টার গল্পের রতনের কথা। এখানেই কি রতন ছিল অথবা ফটিক? কাছাড়িবাড়ির চার দিকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট এবং ব্যস্ততা। ভেতরে ঢুকলেই এক ধরনের নীরবতা ও প্রশান্তি। বিভিন্ন স্থানে বসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য আছে পাকা বেঞ্চ। এক পাশে রয়েছে বিশাল অডিটোরিয়াম। পাশে কয়েকটি জরাজীর্ণ কক্ষ। আসছে শীতে আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠবে কাচারিবাড়ি। প্রচুর ফুল ফুটবে। গাঁদাফুলে ভরে যাবে চারদিক। দর্শনার্থীরা আসছেন, বিশ্রাম নিচ্ছেন। ঘুরে ঘুরে দেখছেন কবির স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরের কাচারিবাড়ি। সেই সঙ্গে সাহিত্যপ্রেমীরা খুঁজছেন সেদিনের সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close