এস এম আরিফুল ইসলাম

  ১৫ নভেম্বর, ২০২১

দূরে কোথাও

সৌন্দর্যের লীলাভূমি প্রাচীন হরিকেল

হরিকেল রাজত্বের মূল ভূখণ্ড ছিল এই সিলেট। ১৪০০ শতকের দিকে এই অঞ্চলে ইসলামি প্রভাব দেখা যায় সুফি দার্শনিকদের আগমনের মাধ্যমে। ১৩০৩ সালে কালৈতিহাসিক মুসলিম ধর্মপ্রচারক হজরত শাহ জালাল (রহ.)-এর আবির্ভাব ঘটে এই সময়ে। তার দরগাহ সিলেটের একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে ভরা সিলেট বিভাগ। সবখানে ছড়িয়ে আছে দৃষ্টিনন্দন সব পর্যটনকেন্দ্র। সবুজে মোড়া পাহাড়ের কোলঘেঁষা পাথুরে নদী, ঝরনা, বন, চা-বাগান, নীল জলরাশির হাওর; কী নেই এখানে। সিলেটের এমন প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য উপভোগ করতে দেশ-বিদেশের পর্যটক আর ভ্রমণপ্রিয় মানুষ ভিড় জমান। সিলেটের বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান আছে, যেখানকার সৌন্দর্য শুধু বর্ষায় গেলেই দেখা যায়। তাই বর্ষার মৌসুমে সিলেট ভ্রমণে গেলে অবশ্যই সেসব স্থানে যেতে ভুলবেন না। জেনে নিন বর্ষায় সিলেট ভ্রমণে যা যা দেখবেন-

জাফলং : প্রকৃতি কন্যা হিসেবে সারা দেশে এক নামে পরিচিত সিলেটের জাফলং। সিলেট ভ্রমণে যাবেন অথচ জাফলং যাবেন না, তা কি হয়? খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জাফলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। পিয়াইন নদীর তীরে স্তরে স্তরে বিছানো পাথরের স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ইন্ডিয়ান পাহাড় টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি, উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য ও সুনসান নীরবতার কারণে এলাকাটি পর্যটকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। সিলেটনগরী থেকে ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলায় জাফলংয়ের অবস্থান। জাফলংয়ে শীত ও বর্ষা মৌসুমের সৌন্দর্যের রূপ ভিন্ন। কয়েক হাজার ফুট ওপর থেকে নেমে আসা সফেদ ঝরনাধারার দৃশ্য যে কারোরই নয়ন জুড়ায়। সিলেট জেলা সদর হতে সড়ক পথে জাফলংয়ের দূরত্ব মাত্র ৫৬ কিলোমিটার। সিলেট থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেতে পারেন জাফলং। সময় লাগবে এক থেকে দেড় ঘণ্টা।

লালাখাল : স্বচ্ছ নীল জলরাশি। দুই ধারে প্রাকৃতিক দৃশ্য। অপরূপ সোন্দর্যময় এক স্থান হলো লালাখাল। দীর্ঘ নৌপথ ভ্রমণের সাধ যেকোনো পর্যটকের কাছেই যেন এক দুর্লভ আকর্ষণ। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের স্থান এটি। সেই সঙ্গে রাতে সেখানকার সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার সন্নিকটে অবস্থিত লালাখান। ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই লালাখালের অবস্থান। চেরাপুঞ্জি পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই নদী বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। সিলেট শহর হতে লালাখালের দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার। বাস, মাইক্রো, টেম্পোযোগে আপনি যেতে পারেন সেখানে।

রাতারগুল : রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। সেখানকার সৌন্দর্য দেখলে যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবেন। রাতারগুল জলাবন বা রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন বা সোয়াম্প ফরেস্ট এবং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, যা সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত। সারা পৃথিবীতে স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশে আছে দুটি। একটি শ্রীলঙ্কায় আরেকটি বাংলাদেশের রাতারগুল। সুন্দর বিশাল এ বনের তুলনা চলে একমাত্র অ্যামাজনের সঙ্গে। অ্যামাজনের মতো এখানকার গাছ বছরে চার থেকে সাত মাস পানির নিচে থাকে। এই বন মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ বনবিভাগ, বেত, কদম, হিজল, মুর্তাসহ নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে। এ ছাড়া জলমগ্ন এই বনে রয়েছে হিজল, করচ আর বরুণ গাছ, আছে পিঠালি, অর্জুন, ছাতিম, গুটি জাম, আছে বট গাছও। এই বনে সাপের আবাস অনেক বেশি। এ ছাড়া রয়েছে বানর, গুঁইসাপ, সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি, ঘুঘু, চিল এবং বাজপাখি। হিজল গাছের সারি ডুবে আছে পানিতে। তার ফাঁক দিয়ে নৌকায় চলাচল করার আনন্দ উপভোগ করতে পারবেন এই জলাবনে গেলে। ইঞ্জিন ছাড়া বৈঠা বাওয়া নৌকা দিয়ে এ বনে প্রবেশ করতে হয়। হরেক রকম পাখিরও দেখা পাবেন সেখানে। মনে রাখবেন জলাবন একটি সংরক্ষিত বন, এখানে কোনো রকম হইহুল্লোড় করবেন না, অপচনশীল কোনো দ্রব্য পানিতে নিক্ষেপ করবেন না। বনের মধ্যে একটি (ঝুঁকিপূর্ণ) ওয়াচ টাওয়ার আছে সেখানে উঠে ওপর থেকে বনটা দেখতে পারবেন। সিলেট শহরের যেকোনো জায়গা থেকে মোটরঘাট সিএনজি নিয়ে যাবেন।

ভোলাগঞ্জ : হোয়াইট স্টোন বা সাদা পাথর। নামটি শুনলেই দেখার প্রত্যাশা জাগে। এমনকি মনের ভেতর জুড়ে এক শুভ্রতা ভর করে। সবুজের বুক জুড়ে প্রকৃতির অপরূপ মহিমা আমাদের হৃদয়কে শুধু প্রশান্তি দেয় না, হৃদয়ে ছড়িয়ে দেয় শ্রান্তির পরশ। পেছনে মেঘালয় ঝরনার স্বচ্ছধারা বের হয়ে এসে আছড়ে পড়ছে সাদা পাথরের দিকে। টলমলে স্বচ্ছ জলধারা সাদা পাথরের বুকে মিলেমিশে একাকার। এ যেন সৌন্দর্যের এক নান্দনিক কৌশল। যা মানব হৃদয়কে শুধু দোলাই দেয় না, পাশাপাশি নিয়ে যায় এক স্বপ্নের দেশে। ভোলাগঞ্জ সিলেট জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানিগঞ্জে অবস্থিত। ভোলাগঞ্জের আরেক পাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের উঁচু উঁচু পাহাড়। সেই পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার পানির প্রবাহ ধলাই নদের উৎস। সবুজ পাহাড়, মেঘের হাতছানি আর বর্ষার পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে নেমে আসা সাদা পাথর ধলাই নদের বুকে মিলেমিশে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এই নদের উৎসমুখের পাথরের জায়গাটুকু ভোলাগঞ্জ জিরোপয়েন্ট বা ‘সাদা পাথর’ নামে পরিচিত। অনেকের মতে সাদা পাথর বিছনাকান্দির চেয়েও সুন্দর। সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। দেশের যেখান থেকেই ভোলাগঞ্জ যেতে চান আপনাকে প্রথমে সিলেট শহরে আসতে হবে। সিলেট থেকে বিআরটিসি বাস, বাস, সিএনজি, লেগুনা বা প্রাইভেট কারে করে যাওয়া যায় ভোলাগঞ্জ। বর্তমানে ভোলাগঞ্জ যাওয়ার রাস্তার অবস্থা খুবই ভালো।

বিছানাকান্দি : মেঘালয়ের কোলঘেঁষা সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থিত বিছানাকান্দি। এটি মূলত একটি পাথরের কোয়ারী। হাদারপার থেকে নৌকা নিয়ে বিছানাকান্দি যাওয়ার পথটাও অনেক সুন্দর। পথের দুই পাশে সবুজের ছড়াছড়ি। যেখানে পাথর নেই; সেখানে নদী বেশ খরস্রোতা। বিছানাকান্দি যাওয়ার রাস্তা বেশ খারাপ। ভালো হয় আম্বরখানা থেকে সিএনজি নিয়ে গেলে। সেখানে নেমে নৌকা রিজার্ভ করবেন। পান্থুমাই আর বিছানাকান্দি একসঙ্গে রিজার্ভ করলে ভালো।

ভ্রমণ মনের শক্তিকে বৃদ্ধি করে, ভ্রমণের সময় সতর্ক থাকুন খাদ্য গ্রহণে এবং নিরাপত্তায়। বর্ষা মৌসুমে ভ্রমণে ছাতা সঙ্গে রাখুন। এ ছাড়া ভেজা কাপড় রাখার জন্য আলাদা পানি নিরোধক ব্যাগ সঙ্গে রাখুন।

লেখা ও ছবি : প্লাবন আমিন

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close