মুহাম্মদ জাভেদ হাকিম

  ১৮ অক্টোবর, ২০২১

দূরে কোথাও

রোমাঞ্চকর তাবাক্ষ গুহার পথে

ভ্রমণপাগলদের ঘুরে বেড়ানোর শখটাকে জগৎ-সংসারের অনেকেই বিবিধ নেতিবাচক ভাবনা গলাটিপে ধরতে চায়। কিন্তু তারা হয়তো জানেন না, প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয় না। কিংবা নৈতিক চরিত্র অধপতনেরও তেমন সম্ভাবনা থাকে না। আলহামদুলিল্লাহ সেদিক থেকে আমি লাকি। তাইতো মাঝেমধ্যেই প্রাণের সংগঠন দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের সঙ্গে দেশের নানা নয়নাভিরাম জায়গায় হুটহাট করেই ছুটে যাই। যেখানে এখনো সাধারণ ভ্রমণপিপাসুদের পদচারণা তেমন নেই, সেসব জায়গাতেই দে-ছুট যেতে বেশি পছন্দ করে। তেমনি এবার লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা বছর দেড়েক আগে আবিষ্কৃত তাবাক্ষ গুহা থেকে ঘুরে এলাম। তাবাক্ষ নামটার মধ্যেই কেমন যেন আদিমতা ভর করে আছে।

ভ্রমণ পরিকল্পনা সব ঠিকঠাক। কিন্তু যাব অচেনা-অজানা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল। তাই দীঘিনালার বাসিন্দা মি. রকি বিশ্বাসের সহযোগিতা নিলাম। তিনি গ্রিন সিগন্যাল দিতেই এক বৃহস্পতিবার রাতের গাড়িতে ছুটলাম খাগড়াছড়ি। ভোরে নেমে প্রথমে হোটেলে সাফসুতর হয়ে, নাশতা সেরে আবার উঠে বসলাম দাদার আমলের চান্দের গাড়িতে। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর মহাসড়ক ছেড়ে তাবাক্ষ গুহার দিকে, পাহাড়ি পথে কিছুটা অগ্রসর হতেই গাড়ি খাদে আটকে যায়। ঠেলা ধাক্কা নাকে দড়ি বেঁধেও গাড়ি আর চলমান কার্যক্রমে আনা গেল না। খাদে আটকা অচল গাড়ি সচল করতে গিয়ে, ভ্রমণকালীন মহামূল্যবান একটি ঘণ্টার পুরোটাই বিফলে।

অতঃপর দুই পা-ই ভরসা। হাঁড়ি-পাতিলসহ বাজার-সদাইয়ের গাট্টি-বস্তা নিয়ে ট্র্যাকিং শুরু। প্রখর রৌদ্র উপেক্ষা করে হাইকিং ট্র্যাকিং চলছে। মাঝেমধ্যে ছায়াঘেরা কোনো গাছতলায় জিরিয়ে নিই। চলতে চলতে চোখে ধরা দেয় শরতের নীল আকাশে পেজা তোলা শুভ্র মেঘের ভেলা। কখনোবা কালো মেঘের ঘনঘটা। ঢেউ খেলানো পাহাড়। জুমের ফসল। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ অরণ্য। উঁচু-নিচু পাহাড়। নলখাগড়ার জঙ্গল। এসবই সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রাণশক্তি। এই শক্তি বেড়ে আরো দ্বিগুণ হলো যখন একটা সময় পুরোপুরি জঙ্গলি পথে ঢুকে গেলাম। শরীরে সাপ প্যাঁচাবে নাকি কোনো হিংস্র জন্তু পা কামড়ে ধরবে, সেদিকে কোনো খেয়ালই ছিল না। সে এক রোমাঞ্চকর ব্যাপার-স্যাপার। সব মিলিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা হাইকিং-ট্র্যাকিং করতে করতে পৌঁছাই বড় মাইরুং ঝরনার ওপরে। গড়িয়ে যাওয়া টলটলে পানির ঝাপটা চোখে-মুখে দিতেই সব ক্লান্তি উবে যায়। আহ কী শান্তি।

এবার জমবে আসল খেলা। দড়ি বেয়ে যখন সবাই তরতর করে ঝরনার পাদদেশে নামছিল, তখন নয়া সঙ্গীদের অনেকেই আমাকে নিয়ে মজা লুটছিল। তাদের ভাবনা আমাকে হয়তো ১১০ কেজির দেহটা নিয়ে ঝরনার ওপরেই বসে থাকতে হবে। কিন্তু না। আমি তো দমে যাওয়ার পাত্র নই। সহযোগিতায় এগিয়ে এলো গাইড মিলন ত্রিপুরা। সাহস জোগালো স্কাউট রেদওয়ানসহ ঘুরতে আসা স্থানীয় তরুণ দিপায়ন ত্রিপুরা। তাদের সহযোগিতায় তরতর করে প্রায় ৯০ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়ের আনুমানিক ৫০-৬০ ফুট নিচে নেমে এলাম। এখানে রয়েছে বড় মাইরুং নামক একটি ঝরনা। এর শ্বেত-শুভ্র হিমহিম ঠাণ্ডা পানি মন কেড়ে নেয়। বয়ে চলা ঝিরির পরিবেশটা দেখতেও বেশ নৈসর্গিক। ঝরনার পানি রিমঝিম ছন্দ তুলে অবিরাম গড়িয়ে পড়ে। এর শীতল পানি চুম্বুকের মতো দেহটাকে টেনে নেওয়ায় ইচ্ছামতো ভিজতে থাকি। সবুজের গালিচায় মোড়ানো গহিন পাহাড়ের বুকচিরে জেগে থাকা বড় মাইরুং ঝরনার সৌন্দর্যও কম যায় না।

ওদিকে দে-ছুটের স্বেচ্ছাসেবকদের কেউ কেউ জঙ্গল থেকে লাকড়ি কুড়িয়ে আনেন। কেউবা বড় বড় পাথর বসিয়ে চুলা বানান। রন্ধন কারিগররা আগুন জ্বালিয়ে রান্নায় ব্যতিব্যস্ত। বাঁশ কুড়াল সংগ্রহ করতে যাওয়া স্থানীয় বগড়াছড়াপাড়ার তরুণীরাও আমাদের রান্নাযজ্ঞে হাত মেলায়। অল্প কিছু দূর গেলেই কাক্সিক্ষত তাবাক্ষ গুহার দেখা মেলবে। কিন্তু না। এখনই যাচ্ছি না। আগে দুপুরের আহার সেরে নেওয়া হবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রেডি হয়ে যায় সাদা ভাত আর মুরগির তরকারি। আহ কী ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ কী তবে ঝরনার পানি দিয়ে রান্নার কারণে নাকি ভুবন ভোলানো প্রাকৃতিক নৈসর্গিক পরিবেশে বসে খাওয়ার জন্য। তা যাই হোক। সবাই মিলে পেট পুরে খাই। খেয়েদেয়ে এবার ছুটলাম তাবাক্ষ।

অল্প কিছুদূর মাইরুং তৈসা ঝিরিপথ ধরে এগোতেই গুহামুখের দেখা মিলল। দেখেই কেমন যেন রহস্যময় লাগে। ভেতরে ঢুকলে না জানি কি হয়। কিন্তু দে-ছুটের দামালদের থামাবে কে। একে একে সবাই সরু গুহার ভেতর ঢুকে পড়ি। একটা সময় পুরোই ঘুটঘুটে অন্ধকার আমাদের আচ্ছন্ন করে। তবু সঙ্গে নেওয়া টর্চের আলোয় এগোতে থাকি। তাবাক্ষর ভেতরটা ভয়ংকর অদ্ভুত সৌন্দর্যে ঘেরা। পাথরের পাহাড়ের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট তাবাক্ষ গুহা। টর্চের আলোয় ওপরের দিকে তাকালে মনের মধ্যে ভয়ানক শিহরনের দোলা দেয়। তাবাক্ষর পাথুরে ছাদজুড়ে যেন রহস্য খেলা করে। গুহার কিছুকিছু জায়গা মাত্র ১৭-১৮ ইঞ্চি পাশ। সেসব জায়গা দিয়েও কাতচিৎ হয়ে অবলীলায় ঢুকে পড়েছি। দলের প্রত্যেকের মাথায় অদেখাকে দেখার নেশা চেপে ধরেছিল। ভয়-ডর সব তখন ছিল ফিকে। কথা একটাই দেখতে হবে তাবাক্ষর শেষ পর্যন্ত পর্যন্ত।

গুহার আঁকাবাঁকা পথে যেতে যেতে একটা সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায় সরু পথের মাঝে থাকা এক খণ্ড পাথর। হয়তো পাথরটি পথ আগলে না রাখলে আরো কিছুটা দূর যাওয়া যেত। খানিকটা সময় পাথরের চিপাচাপা দিয়ে চোখ বুলিয়ে, সেখান থেকেই ফিরতি পথ ধরি। সাংবাদিক অপু দত্তর রিপোর্ট অনুযায়ী তাবাক্ষ গুহা প্রায় ১৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন। প্রায় সাড়ে তিন ফুট প্রশস্তের হলেও, কয়েকটা স্থানে একেবারেই সরু। স্থানীয়রা তাবাক্ষ গুহাটিকে দেবতার গুহা নামেও ডাকেন। ত্রিপুরা ভাষায় তাবাক্ষ অর্থ বাদুড়ের গুহা। যারা যেই নামেই ডাকুক না কেন, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। নিঃসন্দেহে ভ্রমণপিপাসুদের তাবাক্ষ গুহা রোমাঞ্চিত করবে- এটা নিশ্চিত।

যাবেন কীভাবে : ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি রুটে বিভিন্ন পরিবহনের বাস সার্ভিস রয়েছে। ভাড়া ৫০০ থেকে ১২০০ টাকা। খাগড়াছড়ি শহরের শাপলা চত্বর থেকে চান্দের গাড়িতে ১৭ কিলোমিটার দূরত্বের দীঘিনালা উপজেলার আটমাইল নামক এলাকা হয়ে বড়পাড়া/বগড়াছড়াপাড়া পর্যন্ত যেতে হবে। এরপর প্রায় দুই কিলোমিটার পাহাড়ি পথে ট্র্যাকিং।

খাওয়া-থাকা : দিনে দিনে ঘুরে এসে শহরেই থাকতে হবে। তাবাক্ষ অবস্থানকালীন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি ও শুকনো খাবার সঙ্গে নিতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র।

সতর্কতা : অবশ্যই স্থানীয় পাড়াগুলো থেকে গাইড নিয়ে যেতে হবে। নতুবা পথ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close