reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৪ অক্টোবর, ২০২১

পণ্ডিত পবিত্র মোহন দে

যার তবলার বোলে ধ্বনিত হয় বাংলার সুর

তার তবলার তেরে কাটা তেরে কাটা তা, এই ছন্দিত স্পন্দনে দোলে ওঠে বাংলার তরু পল্লব, শ্যামল প্রকৃতি। ঝংকৃত হয় পাষাণ হৃদয়। সেই মহান তবলাবাদক হলেন পণ্ডিত পবিত্র মোহন দে। এ শতাব্দীর দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকে ময়মনসিংহে বিশেষ করে মুক্তাগাছার জমিদার জগৎ কিশোর আচার্যের, গৌরীপুরে, ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, রাম গোপালপুরের ও

ময়মনসিংহ শহরে শশীকান্দ আচার্যের দরবারে হিন্দুস্তানী উচ্চাঙ্গ সংগীতের বহু খ্যাতনামা কলাবন্ত এসে এক স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করেছিল।

তবলা বাদনে মুক্তাগাছায় বেনারসের মৌলভীরাম মিসির, গৌরীপুরে ফরাক্কাবাদ ঘরানার (দিল্লি) মসিদ খাঁ (ওস্তাদ কেরামত উল্লার খাঁর বাবা) এবং সেতারের কিংবদন্তি এনায়েৎ খাঁর (বেলায়েত খাঁর বাবা) উপস্থিতি ময়মনসিংহকে উচ্চাঙ্গ সংগীতের এক অনন্য ভূবন সৃষ্টি করেছিল। তবলা বাদনে মৌলভীরাম ও মসিদ খাঁর ঘরানার মিশ্রণ হলো ময়মনসিংহে। এ মিশ্রণের অনন্য ফসল হলো পণ্ডিত বিপিন রায়, উপেন রায়, রাম কৃষ্ণ কর্মকার, মিথুন দে ও অন্যান্য কালজয়ী শিল্পী ও শিক্ষক। সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের দীপশিখাকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন বিপিন বিজয় মিথুন। সেতারে বিপিন দাস, কণ্ঠে বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচার্য এবং মিথুন দে তবলায় ও কণ্ঠে। এদের উত্তরসূরি হিসেবে পারুল ভীষ্ম আভা ৫০ দশকের শেষ দিক থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীতকে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল ষাটের দশক পর্যন্ত।

কৃতি অগ্রজ মিথুনদের তালিম নিয়ে পবিত্র তবলা বাদনের ধারাকে বহন করে আসছে পরিশীলিত গানের মাইফেলে। ৫০, ৬০, ৭০, ৮০-এর দশক পার হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করলেন পবিত্র দে। খেয়ালগান, রবীন্দ্র সংগীত ও উচ্চাঙ্গী নৃত্যের সংগতে পবিত্র দে এক অসাধারণ প্রতিভা। তার সমৃদ্ধ ও শৈল্পিক বাদন অমৃতের ধারা বয়ে দেয়- গান হয়ে ওঠে ছবি এবং অফুরন্ত আনন্দের উপকরণ। মিথুনদের জীবদ্দশাতেই পবিত্র দে তবলা শিক্ষাদান ও বাদনে

ময়মনসিংহ ও বাংলাদেশে এক অনন্য স্থানে আসন করে নিয়েছেন। উচ্চাঙ্গ ও পরিশীলিত সংগীতে আমাদের চারপাশে পবিত্রদের মতো যোগ্য মানুষ নেই।

১৯৩৭ সালের ১ মে, আকুয়া, চুকাইতলা, ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণকারী পবিত্র দে ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করার পর আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি হয়। সেখানে শিক্ষক পান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, সৈয়দ বদর উদ্দিন হোসেন এবং আরো বিশিষ্ট অধ্যাপকদের। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সৈয়দ বদর উদ্দিন হোসেন পড়াতেন ইতিহাস। এ ছাড়া তারা কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাট্য বিভাগে যুক্ত ছিলেন। পবিত্র দে কলেজে পড়া অবস্থায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটকে তবলা সংগত করতেন। আলোকময় নাহা উক্ত কলেজে পড়তেন, যদিও পবিত্রদের সিনিয়র ছিলেন। অনুষ্ঠানে গান গাইতেন আলোকময় নাহা ও অন্যরা। সেই সুবাদে পবিত্র দের ভালো পরিচিতি হয় সবার সঙ্গে। আলোকময় নাহা প্রায়ই পবিত্র দেকে বাসায় নিয়ে যেতেন গান সংগত করার জন্য।

এক দিন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ব্যক্তিগত কাজের জন্য কলেজের অফিস কক্ষে যান। কাজের ফাঁকে বললেন মোহিনী বাবু আমার ছেলেমেয়েদের বাসায় পড়ানোর জন্য একজন প্রাইভেট শিক্ষকের ব্যবস্থা করে দেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে মোহিনী দে পবিত্রদের মেঝো ভাই। তখন মোহিনী দে বললেন, স্যার, আমার ছোট ভাই আপনার ছাত্র, এ কলেজে পড়ে। পরে নজরুল সাহেব বললেন ওর নাম কী? পবিত্র দে। ও চিনতে পেরেছি, তবলা বাজায়, হ্যাঁ স্যার। আপাতত ও পড়াক, ওপরের ক্লাসের দিকে উঠলে আমি পড়াব। উত্তরে নজরুল সাহেব বললেন ঠিক আছে। আপনি আমার বাসা চিনেন তো?

তখন মোহিনী দে (মোহিনী দে কলেজে ক্লারিকেল পোস্টে চাকরি করেন) হ্যাঁ স্যার চিনি। তখন নজরুল সাহেব বললেন, পবিত্রকে বাসায় নিয়ে যাবেন আমি বাসায় বলে রাখব। এক দিন মোহিনী দে পবিত্রকে বাসায় নিয়ে গেলেন। ছেলেমেয়েদের ডেকে পরিচয় করে দিয়ে বললেন এই স্যার এখন থেকে তোমাদের পড়াবেন। পবিত্র দে যথারীতি পড়াতে লাগলেন। এক দিন পড়ানোর ফাঁকে পবিত্র দে শুনতে পেলেন ভেতরে নজরুল সাহেব বলছেন মাস্টারকে ভালো নাশতা দেবে। সে একজন ভালো তবলা বাদক, আমার ছাত্র। কলেজের অনুষ্ঠানে তার তবলা বাদন শুনেছি।

পবিত্র দে কেবল সংগীতই নয়, ছবি আঁকাও তার একটা শখ। এ ছাড়া মৃৎশিল্পেও পটু ছিলেন। ছাত্র অবস্থায় বহু মাটির মডেল তৈয়ার করেছেন, যা প্রশংসনীয়। পবিত্র দের আর একটি প্রশংসনীয় ব্যাপার হলো তার বাংলা এবং ইংরেজি হাতের লেখা। এসব বিষয় উপেক্ষা করে সংগীত চর্চাতেই মনোযোগ দেন এবং অগ্রজ মিথুনদের কাছে তবলার তালিম নিতে থাকেন। তার কাছ থেকেই তবলার তালিম শেষ করেন। তৎসময়ে ময়মনসিংহ শহরে অনুষ্ঠানে তবলা বাদক একমাত্র পবিত্র দে, যার ফলে কলেজের পড়া আর হয়ে ওঠেনি।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সবাই কলকাতা চলে যান। সেখানে পৌঁছে পবিত্র দের মেঝো ভাই মোহিনীদে সৈয়দ নজরুলের সঙ্গে দেখা করে বলেন, স্যার এখানে পরিবার-পরিজনসহ জীবন বাঁচাতে এসেছি, আমাকে একটা ব্যবস্থা করে দেন। তখন নজরুল সাহেব বললেন, আপনারা এত দেরি করলেন কেন? কতজনকে চাকরি দিলাম। আপনাদের কাউকেই দেখি না। এখন তো প্রায় শেষ সময়। তবু তিনি মোহিনীদেকে হতাশ করেননি। ওই সময় নজরুল সাহেব থাকতেন কলকাতায় অশোক ঘোষের বাসায়। তার কথা রাখলেন এবং বললেন মোহিনী বাবু প্রথমে ৯টা থেকে ৯টা ৩০ মিনিটে এসে ছেলেমেয়েদের পড়াবেন পরে থিয়েটার রোডে আমাদের বাংলাদেশ অফিসে চাকরিতে জয়েন করবেন। এক দিন মোহিনী দে পবিত্রকে জানালেন আমি নজরুল সাহেবকে ধরে একটি চাকরির ব্যবস্থা করেছি। পরে বললেন ৯টা থেকে ৯টা ৩০ মিনিটের মধ্যে আমার সঙ্গে কলকাতা অশোক ঘোষের বাসায় দেখা করবি। আমি নজরুল সাহেবের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানোর পর থিয়েটার রোডে চাকরি করার জন্য চলে যাই। পবিত্র দে মাঝে মাঝে ওখানে যেতেন এবং মোহিনী দে তাকে কিছু টাকা দিয়ে দিতেন। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে পবিত্র দে দেশে ফিরে চাকরিতে জয়েন করেন। তারপর মোহিনী দে নজরুল সাহেবের পরিবারকে ঢাকা পৌঁছে দেন।

উল্লেখ্য পবিত্র দে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতায় শরণার্থী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচিত হন। সেখানে ওয়াহিদুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন। ওয়াহিদুল হক পবিত্রকে অন্য একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করে দেন। ওই সংগঠনটির মধ্যে তখনকার পূর্বপাকিস্তানের বিভিন্ন জেলার শিল্পীরা ছিলেন। এই মুহূর্তে সব শিল্পীর নাম মনে নেই, যাদের কথা মনে আছে তাদের মধ্যে ওয়াহিদুল হক, কমল সরকার, রত্ন সরকার, সুশান্ত সাহা, বিপুল ভট্টাচার্য, দীপক মুখার্জি, মিতালী মুখার্জি এবং পবিত্র দেসহ আরো অনেকে।

পবিত্র দে পরিশীলিত সংগীতে তবলা পাখোয়াজ বাদন এবং শিক্ষা ও দেশসেবায় নিবেদিত, যার ফলে নিম্নে প্রদত্ত বিভিন্ন সংগীত সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান তাকে সংবর্ধনা দিয়ে সম্মানিত করেছে-

উদীচী ময়মনসিংহ জেলা শাখা পরিচালিত আলোকময় নাহা সংগীত বিদ্যায়তন সম্মাননা ১৯৮৪ সন। জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন অষ্টাবিংশ জাতীয় সম্মেলন মার্চ, ২০০৯ সন। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে শিল্পকলা পদক গ্রহণ ২০১৬ সন। বিশ্ব সংগীত দিবস, বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, ময়মনসিংহ বিভাগ ২০১৯ সন। উদীচী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ সম্মাননা ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সন। জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ (কেন্দ্রীয়) ঢাকা থেকে সম্মাননা (অষ্টবিংশ জাতীয় সম্মেলন) ২২ মার্চ ২০০৯। জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ ময়মনসিংহ জেলা শাখা, ময়মনসিংহ সম্মাননা ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সন। যন্ত্র সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য জেলা শিল্পকলা একাডেমি, ময়মনসিংহ সম্মাননা ২০১৫ সন। গুণীজন সম্মাননা, কিরণ স্মৃতি সংগীত বিদ্যালয়, চন্ডীপাশা, নান্দাইল, ময়মনসিংহ ২০২০ সন।

পবিত্র দে ১৯৯৪ সনে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণ করার পর ঢাকায় ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনে চার থেকে পাঁচ মাস তবলা শিক্ষকতা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে আর না থেকে ময়মনসিংহ চলে আসেন। এখানে এসে বিভিন্ন সংগীত বিদ্যালয় ও সংগীত প্রতিষ্ঠানে তবলার শিক্ষকতা করে চলেছেন। বর্তমানে পবিত্র দে অসুস্থতার কারণে আর গান বাজনা করেন না। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ও তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করছেন নিজ বাড়িতে। তার ছেলে প্রশান্ত দে ময়মনসিংহের সংগীত অঙ্গনে জড়িত। একান্ত অনুরোধের ফলে ময়মনসিংহ উদীচী পরিচালিত আলোকময় মহাসংগীত বিদ্যায়তনে অধ্যক্ষের পদে নিয়োজিত আছেন। সর্বপরি আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে, পবিত্র দেকে জাতীয় পদক প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে সম্মানিত করলে তার প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো হবে। পবিত্র দে একজন প্রচারবিমুখ শিল্পী। শেষ বয়সে (বর্তমানে ৮৫ বছর চলছে) এসে যদি জাতীয় সম্মাননাটুকু পান তবে নিজেকে সারা জীবনের সংগীত সাধনার মূল্যায়নটুকু পাবেন- এটাই সবার প্রত্যাশা।

তথসূত্র : সংগৃহীত

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close