মো. বশিরুল ইসলাম

  ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

গৌরব ও ঐতিহ্যের ২১ বছর

বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা কৃষিকেন্দ্রিক। তাই আধুনিক কৃষি শিক্ষার মাধ্যমে এ দেশের কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্য তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৩৮ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করেন ‘দ্য বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট’। এরপর বিভিন্ন নামে পরিবর্তিত হয়ে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ১৭তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে। অত্যন্ত গৌরবের বিষয় এ বিশ্ববিদ্যালয় ২০ বছর জ্ঞান বিতরণ করে ২১ বছরে পদার্পণ করল।

বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এ ইতিহাস মাত্র ২০ বছরের হলেও উপমহাদেশের প্রচীনতম উচ্চতর কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর ইতিহাস দীর্ঘ ৮৩ বছরের। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই কৃষি উন্নয়নের গুরুদায়িত্ব বহনে সক্ষম তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী তৈরি এবং কৃষি গবেষণার যথাযথ প্রচার ও প্রসারে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এ প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কৃষি গ্র্যাজুয়েট তৈরি হয়েছে। যারা অবদান রাখছে কৃষিসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এ বিদ্যাপীঠের নাম ছড়িয়েছে আন্তর্জাতিক পরিম-লে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং অর্জন স্বাভাবিকভাবেই সবাই আলোচনায় করছে এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরোত্তর উন্নতি কামনা করছে। গবেষণা, শিক্ষা ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে দেখতে চান সবাই। তার আগে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খানিকটা তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করছি।

এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মূলত উপমহাদেশের কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি রচিত হয়েছিল। ইংল্যান্ডের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি কারিকুলাম অনুসরণপূর্বক ১৯৪১ সালে ইনস্টিটিউটের অ্যাকাডেমিক যাত্রা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ জন মুসলমান ও ১০ জন হিন্দু ছাত্র নিয়ে বিএসসিএজি কোর্স শুরু হয়। এরা দুই বছর বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোতে লেখাপড়া করে পরীক্ষা দিয়ে মেধা ভিত্তিতে বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউটে গিয়ে ভর্তি হতে পারত। দুই বছর কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর পড়ালেখা করে পরীক্ষা পাসের পর কৃতী শিক্ষার্থীরা জেলা কৃষি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে চাকরি করতে পারত। এরাই ১৯৪৩ সালে বাংলার প্রথম কৃষি গ্র্যাজুয়েট।

১৯৪৫-৪৬ শিক্ষাবর্ষে আইএসসি পাসের পর ত্রিবার্ষিক বিএজি ডিগ্রি কোর্স চালু করা হয়। যদিও মৌলিক অনুষদের মর্যাদা তখনো অক্ষুণ্ন থাকে। তার সঙ্গে চার বছরের কোর্সটিও ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত চলতে থাকে। ফলে ১৯৪৮ সালে পুরোনো ও নতুন মিলে দুটি ব্যাচের শিক্ষার্থীরা একই বছরে ডিগ্রি পায়। ১৯৫১ সালে এমএজি কোর্স চালু করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন এর নাম ছিল বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট, পাকিস্তান আমলে এর নাম হয় পূর্বপাকিস্তান অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর নাম রাখা হয় বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। তবে সর্বসাধারণের কাছে এটি ইনস্টিটিউট হিসেবে পরিচিত না পেয়ে ‘কৃষি কলেজ’ হিসেবেই খ্যাতি লাভ করে। এ দেশের দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের অন্নের সংস্থান, কৃষি শিক্ষা, কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণে এ ইনস্টিটিউটের গ্র্যাজুয়েটরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। অথচ এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত না করে ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬৪ সালে এ ইনস্টিটিউট কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত কলেজ হিসেবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। ১৯৮৯ সালে তদানীন্তন সরকার বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটকে (বিএআই) স্বায়ত্তশাসন প্রদানের ঘোষণা দিলেও ১৯৯০ সালে পরবর্তী সরকার তা বাতিল করে। এর ফলে বিএআই যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই রয়ে যায়।

২০০১ সালের ৬ জানুয়ারি বিএআই হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেন এবং ৯ জুলাই, ২০০১ সালে সংসদে আইন পাস করে। ১৫ জুলাই, ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে প্রফেসর মো. শাদাত উল্লাকে প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি ও অত্র প্রতিষ্ঠানের সাবেক ছাত্র কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক কৃষিমন্ত্রী এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম মহবুবউজ্জামান, বাংলাদেশ কৃষক লীগের সভাপতি কৃষিবিদ সমীর চন্দ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী কৃষিবিদ মশিউর রহমান হুমায়ুনসহ বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট সাবেক ছাত্র সমিতির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

১৯৪৩ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব গ্র্যাজুয়েট পাস করেছে মূলত তারাই সূচনা করেছে এ দেশের কৃষি গবেষণা কার্যক্রমের। ৭৪-এর দুর্ভিক্ষের সময় এই প্রতিষ্ঠানের গ্র্যাজুয়েটরা কৃষকদের সঙ্গে মিলেমিশে এ দেশের কৃষিকে চলমান রেখেছিলেন, যার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের সময় এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও গৌরবময়। জানা যায়, তৎকালীন সময়ে পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে ঢাকার ছাত্রনেতারা আশ্রয় নিতেন এ প্রতিষ্ঠানের হলগুলোতে। ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের অংশগ্রহণও ছিল লক্ষ্যণীয়।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে চারটি অনুষদ ও একটি ইনস্টিটিউটের অধীনে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি কোর্সে ৪ হাজার ৮০৪ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা পাস করে দেশ-বিদেশে কৃষি উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। ২০১৫ সালের ১৬ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষক সংখ্যা ৩২২, কর্মকর্তা ২৭৪। শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণার জন্য রয়েছে পাঁচটি খামার। শিক্ষার্থীদের জন্য সাতটি আবাসিক হল রয়েছে। তার মধ্যে ছেলেদের জন্য তিনটি, মেয়েদের জন্য দুটি এবং দুটির নির্মাণ প্রক্রিয়া চলমান। যা শিগগিরই উদ্বোধন করা হবে।

শিক্ষক, গবেষক ও ছাত্ররা কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের মাধ্যমে গবেষণা করে নতুন নতুন ফসলের জাত আবিষ্কার করে যাচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের উপায় নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীকে সবুজে আচ্ছাদিত করার জন্য ছাদ বাগান নিয়ে চলছে ব্যাপক গবেষণা। সুন্দরবনের সব ধরনের প্রাণীর জেনেটিক বার কোড নির্ণয় ও বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবনসহ আন্তর্জাতিক মানের মৌলিক ও ফলিত গবেষণা করছেন। দেশে প্রথমবারের মতো ইঁদুরের মধ্যে মানুষের অন্তঃপরজীবী (কৃমি) গনজাইলোনেমা শনাক্ত করতে সফল হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের একদল গবেষক। বাংলাদেশে মূল্যবান ফসল জাফরান উৎপাদনে সাফল্য লাভ করেছে।

প্রথমবারের মতো টার্কি মুরগির কৃত্রিম প্রজনন করা হয়েছে। সম্প্রতি সূর্যের আলো ছাড়া সবজি চাষ, কৃত্রিম আলোর মাধ্যমে স্বল্প সময়ে সবজির বীজ উৎপাদন কৌশল আবিষ্কার, মৌমাছির কৃত্রিম প্রজনন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন একদল গবেষক। উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মধ্যে সাউ সরিষা-১, সাউ সরিষা-২, সাউ সরিষা-৩, সাউ টমাটিলো-১, সাউ টমাটিলো-২, সাউ হাইব্রিড ভুট্টা-১, সাউ হাইব্রিড ভুট্টা-২, সাদা ভুট্টা, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় আলু বীজ ও পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনে সফলতা, রুকোলা, বাটন মাশরুম, জামারুসান মুলা, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বিভিন্ন বিদেশি ফুলের উৎপাদন সফলতা উল্লেখযোগ্য। এরমধ্যে দেশে প্রথম ল্যাসেনথিরাস গাছের ফুল ফোটান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যা বাণিজ্যিকভাবে সফলভাবে চাষ হচ্ছে। উদ্যানতত্ত্ব খামারে গোলাপ বাগানে নানা প্রজাতির লাল, হলুদ, সাদা, গোলাপি, পার্পল, কালো ও সবুজ রঙের গোলাপের ওপর গবেষণা করা হচ্ছে। অনেক শিক্ষক পেঁয়াজ, পানপাতা, বাসমতি ধান, মুলা নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে গড়ে উঠেছে একটি আধুনিক টিস্যু কালচার ল্যাব।

প্রশাসনিক ভবনের ঠিক পূর্ব পাশে ছয়তলাবিশিষ্ট স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রন্থাগার স্থাপন করা হয়েছে। এখানে রয়েছে ডিজিটাল লাইব্রেরি। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় এবং আরএফআইডি টেকনোলজিসমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে রয়েছে ৪১ হাজারেরও বেশি দেশি-বিদেশি বই, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ম্যাগাজিনের এক বিশাল সংগ্রহশালা। এ ছাড়াও এ গ্রন্থাগারের জন্য একটি অ্যাপ ডেভেলপ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে যখন-তখন যেখানে-সেখানে বসে দরকারি বই পড়া ও তথ্য সংগ্রহ করা যাবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে দেশের প্রথম ভার্চুয়াল ক্লাসরুম, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম শ্রেণিকক্ষে অংশগ্রহণ করতে ও শিখতে পারবে। গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত শেকৃবিসহ অন্যান্য কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল ও থিসিস পেপারের জন্য একটি ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করা হয়েছে, যাতে প্লেগেরিয়াজম রোধ করা যাবে। আমি বিশ্বাস করি, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় তার আপন মহিমায় জাগ্রত থেকে সব নেতিবাচক কর্মকা- বর্জন করে শিক্ষা ও গবেষণাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে আরো দৃঢ় প্রত্যয়ী হবে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হবে অন্যতম চালিকাশক্তি। আর দক্ষ কৃষিবিদ গড়ার কাজে আরো বেশি নিয়োজিত থেকে দেশের কৃষি, কৃষক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে- এ প্রত্যাশাই রইল।

লেখক : উপপরিচালক

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close