reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দূরে কোথায়

সোনালি ঐতিহ্যের সোনারগাঁয়ে

বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর

সোনারগাঁয়ে বেড়াতে গেলে প্রথমেই আপনি যা দেখবেন তা হলো আবহমান গ্রাম-বাংলার লোকসংস্কৃতির ধারাকে পুনরুজ্জীবন, সংরক্ষণ ও বিপণনের জন্য গড়ে ওঠা বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন; যা সোনারগাঁ জাদুঘর নামে পরিচিত। আপনি বাসে কিংবা প্রাইভেট কারে সোনারগাঁয়ে এসে প্রথমে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা আসতে হবে। পরে যদি বাসে আসেন তাহলে রিকশায় চড়ে আপনাকে সোনারগাঁ জাদুঘরে আসতে হবে।

এখানে এলে আপনার প্রথম নজর কাড়বে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় ১০০ বছরের প্রাচীন এক অট্টালিকা ভবন। এই ভবনটি পুরোনো বড় সর্দার বাড়িখ্যাত। বড় সর্দার বাড়িটি আরো আকর্ষণ করতে সংস্কার করেছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াংওয়ান করপোরেশন। বড় সর্দার বাড়িটি জাদুঘরের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন স্থাপত্য ভাস্কর্য দুটি ঘোড়া; যা সোনারগাঁ জাদুঘরের কথা বললেই এই দুই ঘোড়া দেখলে সবাই অনায়াসে চিনতে পারে।

আপনি জাদুঘরে প্রবেশ করেই আরো দেখতে পাবেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তৈরি গরুর গাড়ির ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবক্ষ ভাস্কর্য ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্য; যা দেখেই আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। এখানে এলেই আপনি ঘুরে ঘুরে দেখতে পাবেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন স্মৃতি জাদুঘর ও বড় সর্দার বাড়ি ভবনের গ্যালারি। যেখানে দেখতে পাবেন কাঠখোদাই, কারুশিল্প, পটচিত্র ও মুখোশ, আদিবাসী জীবনভিত্তিক নিদর্শন, গ্রামীণ লোকজীবনের পরিবেশ, তামা-কাসা-পিতলের গড়া লোকজ বাদ্যযন্ত্র ও পোড়ামাটির নিদর্শন, লোকজ অলংকারসহ অনেক কিছু।

এখানে রয়েছে লাইব্রেরি, ডকুমেন্টেশন সেন্টার, ক্যানটিন, সেমিনার হল, সোনারতরী মঞ্চ, গ্রামীণ উদ্যান, হরেক রকম বৃক্ষ, মনোরম লেক, লেকের মাঝে ঘুরে বেড়ানোর জন্য পঙ্খীরাজ নৌকা, মৎস্য শিকারের ব্যবস্থা, অপরূপা সেতু। এ ছাড়া আপনি আরো একটি আকর্ষণীয় এলাকা দেখতে পাবেন জাদুঘরের পশ্চিম প্রান্তে। যেখানে রয়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে কারুশিল্প গ্রাম। বৈচিত্র্যময় লোকজ স্থাপত্যে গড়া মানোরম ঘর। এ ঘরগুলোতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অজানা-অচেনা অথচ দক্ষ কারুশিল্পীরা বাঁশ-বেত, কাঠখোদাই, মাটি, জামদানি, নকশিকাঁথা, পাটশিল্প, ঝিনুক, কামার, শঙ্খশিল্প, রেশমশিল্প, একতারা ইত্যাদি উৎপাদন করছেন। এখানে কারুপণ্য প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি আপনার পছন্দের কারুপণ্য কিনতে পারেন। ভ্রমণও হলো আর কেনাকাটাও সারা হলো।

তবে সোনারগাঁ জাদুঘরে এলেন আর জানলেন না জাদুঘরটি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা কী হয়? তাহলে জেনে নিন সেই ইতিহাস- ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন প্রতিষ্ঠা করেন লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁ জাদুঘর)। প্রথমে এটি ঐতিহাসিক পানাম নগরীর একটি পুরোনো বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ১৯৮১ সালে ১৫০ বিঘা আয়তনের কমপ্লেক্সে এ দেশের সাধারণ মানুষের শৈল্পিক কর্মকা-ের পরিচয়কে তুলে ধরতে শিল্পী জয়নুল আবেদিন এই জাদুঘর গড়ে তোলার প্রয়াস নেন।

লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে বুধবার ও বৃহস্পতিবার। অন্যান্য দিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। জাদুঘরে প্রবেশ ফি দুটি ভবনের গ্যালারিসহ ৩০ টাকা।

পানাম নগরী

জাদুঘর থেকে বেরিয়ে ঠিক উত্তরদিকে গেলেই আপনি দেখতে পাবেন ঐতিহাসিক পানাম নগরী। এখানে রয়েছে হাজার বছরের প্রাচীন স্থাপত্যকলা ও শিল্পের অনুপম নিদর্শনে ভরপুর। রাস্তার দুই পাশে শত শত বছরের পুরোনো অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে। পানামে এলেই মনের ভেতর এক অন্যরকম অনুভব হবে। পানামে এলেই আপনি দেখতে পাবেন এখানকার চারদিকে পরিখাবেষ্টিত দুদিকে ফটকসমৃদ্ধ ইমারতরাজি, শোভিত নাচঘর, নহবতখানা, দরবারকক্ষ। পানামের এক পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঙ্খীরাজ খাল। একটু উত্তরদিকে গেলে দেখতে পাবেন পঙ্খীরাজ সেতু (পানাম সেতু) ও নীলকুঠি। ঈশা খাঁর সময়কালে এই নগরী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল।

সোনারগাঁয়ে রাজদ- বা রাজকার্য পরিচালিত হতো এই পানাম নগরী থেকেই। এ নগরীই যে প্রাচীন বাংলার রাজা-বাদশাহদের বাসস্থান ছিল তার প্রমাণ এই অঞ্চলের স্থাপত্য নিদর্শনগুলোর মধ্যেই পাওয়া যায়। আর এ কারণে পানাম গড়ে উঠেছিল বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে; যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের স্বাক্ষর স্বরূপ। এ নগরীতে আরো রয়েছে- খাজাঞ্চিখানা, ঠাকুরঘর, গুপ্তপথ, মঠ, মন্দির, পুরোনো লোক কারুশিল্প জাদুঘর ভবন, পোদ্দারবাড়ি, চার শ বছরের প্রাচীন টাকশাল বাড়ি, বিনোদন পিকনিক স্পট, ট্যুরিস্ট হোম এবং প্রাচীন বিদ্যাপীঠ সোনারগাঁ জিআর ইনস্টিটিউশন।

সম্প্রতি পানাম নগর প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর আধুনিক পর্যটন নগরীর জন্য কাজ করছে। সোনারগাঁয়ে ভ্রমণে এলে আপনি পানামে অনায়াসে ঘুরে যেতে পারেন। পানামের বাইপাস সড়কের পাশে রয়েছে মনোরম লেক। এ লেকে নৌকায় চড়ে খুব আনন্দে বেড়াতে পারবেন আপনি। জাদুঘর থেকে পানামে রিকশা ভাড়া নেবে ১০-১৫ টাকা। পানাম নগরের প্রবেশ ফি ১৫ টাকা।

আরো যা আছে

লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের ২ নম্বর প্রবেশপথ থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গেলে দেখতে পাবেন প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্য গোয়ালদী আলাউদ্দিন হোসেন শাহি মসজিদ। জাদুঘর থেকে সেখানে যেতে রিকশা ভাড়া নেবে ২০-৩০ টাকা। আর মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা বাসস্ট্যান্ড থেকে ৪০-৫০ টাকা। মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা গিয়ে একটু দক্ষিণ দিকে মোগড়াপাড়া বাজারের পশ্চিমে গেলে দেখতে পাবেন প্রাচীন সব ইমারতরাজি, বারো আউলিয়ার মাজার। হজরত শাহ ইব্রাহিম দানিশ মন্দ ও তার বংশধরদের মাজার, ইউসুফগঞ্জের মসজিদ, দমদমা গ্রামে দমদম দুর্গ, সুলতান গিয়াসউদ্দিন আযম শাহের সমাধি, পাঁচ পীরের মসজিদ ও মাজার। এসব প্রাচীন কীর্তি ও দর্শনীয় স্থান দেখতে হলে আপনি সোনারগাঁয়ে ভ্রমণে এলে সরাসরি প্রাইভেট কারে কিংবা রিকশাযোগে যেতে পারেন।

জাদুঘরে যাওয়ার পথে দিঘিরপাড় গ্রামের পূর্বে রয়েছে ঐতিহাসিক মসলিনপাড়ার গ্রাম খাসনগর। রয়েছে হিন্দু সম্প্রাদায়ের তীর্থভূমি বারদী লোকনাথ ব্রহ্মাচারী আশ্রম, এর পাশে পূর্বদিকে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসুর বাড়ি। ওই বাড়িতে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবসু স্মৃতি জাদুঘর। সেখানে আপনি রিকশা কিংবা সিএনজিযোগে যেতে পারেন।

আপনি সোনারগাঁয়ে যেখানে যান না কেন রিকশা, সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোতে ঘোরাঘুরি করলে আগে থেকেই ভাড়া দরদাম করে নিলেই ভালো। এ ছাড়া সোনারগাঁয়ে বেড়াতে এসে দুপুরে খেতে হলে এখানকার বিভিন্ন স্পটে অনেক হোটেল রয়েছে। খাবারের আগে দাম জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে। যাতে খাওয়ার পর কোনো বিড়ম্বনায় ভুগতে না হয়।

যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তা হয়ে উত্তরদিকে পর্যটন নগরী সোনারগাঁয়ের অবস্থান। ঢাকা থেকে বাসে কিংবা প্রাইভেট কারে সোনারগাঁওয়ে যাওয়া যাবে। সময় লাগবে বাসে এক থেকে দেড় ঘণ্টা এবং প্রাইভেট কারে এক ঘণ্টা। ঢাকায় গুলিস্তান এসে হকি স্টেডিয়ামের পাশে বাস কাউন্টার রয়েছে। এখান থেকে ঢাকা-মেঘনা সড়কের দোয়েল সার্ভিস, স্বদেশ পরিবহন, বোরাক বাসে চড়ে মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় নামতে হবে। বাসভাড়া ৪০-৪৫ টাকা। এ ছাড়া প্রাইভেট কারেও আপনি আসতে পারেন। যদি বাসে আসা হয় তাহলে চৌরাস্তা বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশাযোগে উত্তরদিকে পর্যটক নগরী সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (সোনারগাঁ জাদুঘরে) যেতে হবে। সেখানে রিকশা ভাড়া নেবে ২০-৩০ টাকা। এ ছাড়া জাদুঘর থেকে যাওয়া যাবে আরেক পর্যটন স্পট বাংলার তাজমহলে। লোকশিল্প জাদুঘর থেকে সিএনজিতে সরাসরি ও বাসে বাঁধন সার্ভিসে মদনপুর নেমে আবার বাঁধন বাসে বাংলার তাজমহলে যাওয়া যায়। সিএনজি ভাড়া ১৫০-২০০ টাকা।

কোথায় থাকবেন

ঢাকা থেকে সোনারগাঁয়ে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সাধারণত থাকার পরিকল্পনা থাকে না। ঢাকার খুব কাছাকাছি বলে একদিনে আপনি ঘোরাঘুরি শেষে আবার বাসায় ফিরে যেতে পারবেন। দূর থেকে যারা এখানে বেড়াতে আসেন তারা অনেক সময় থেকে যেতে চান। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য হলো- এখানে একটি থ্রি-স্টার মানের ‘সোনারগাঁ রয়েল রিসোর্ট’ নামে একটি রিসোর্ট রয়েছে। এটি লোকশিল্প জাদুঘরের পাশেই খাসনগর দিঘিরপাড় এলাকায় অবস্থিত। এখানে রাতযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে থাকতে হলে আগেই বুকিং দিতে হবে। এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে একটি রেস্টহাউস রয়েছে এখানে। সেটি এমএ সাত্তার কেন্দ্রীয় গণবিদ্যালয় (বেইস) নামে পরিচিত। এখানে অনেকগুলো মনোরম কক্ষ রয়েছে। জাদুঘরসংলগ্ন খাসনগর দিঘিরপাড় ইছাপাড়া গ্রামে এর অবস্থান। এ ছাড়া সরকারি অতিথিদের জন্য জাদুঘর ও উপজেলা প্রশাসনের নিজস্ব গেস্টহাউস রয়েছে।

- হাসান মাহমুদ রিপন

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close